যথার্থ সভ্য সমাজে আইনপুস্তকের ঘা মারিয়া নাগরিককে নীতিবোধের শিক্ষা দেওয়া হয় না। নীতিনিষ্ঠা, সদাচার, কর্তব্যপালন, এগুলি পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্র হইতে মানুষ আত্মস্থ করিয়া থাকে। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের ঘন ঘন কর্মবিরতি বন্ধ করিতে রাজ্য সরকার একটি আইন প্রণয়ন করিবে, এই সংবাদ সহসা উৎসাহ জাগায় না। আইন করিয়া যদি অসদাচরণ বন্ধ করা সম্ভব হইত, তবে ভারত এই বিশ্বের সর্বাধিক শিষ্ট, নীতিনিষ্ঠ রাষ্ট্র হইত, সন্দেহ নাই। যে কোনও সমস্যার প্রতিকারে আরও একটি আইন কোন কাজে লাগিবে? কিন্তু এ রাজ্যের তরুণ চিকিৎসকরা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছেন, যে আইন করিবার উদ্যোগ না মানিয়া উপায় নাই। কী ঠিক, কী ভুল, তাহা আজ ডাক্তারদের চোখে আঙুল দিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে, ইহাই তিক্ত বাস্তব। অন্যথায় রোগীর সামান্য চিকিৎসাটুকু নিশ্চিত করা যাইবে না। হাসপাতালগুলিতে অব্যবস্থা চলিতেই থাকিবে।
আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির কারণটি অমূলক নহে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ পাইবার অধিকার সকলেরই রহিয়াছে, ডাক্তাররা তাহার ব্যতিক্রম নহেন। কিন্তু জনসংযোগমূলক নানা পেশাতেই নিরাপত্তায় ঝুঁকি থাকিয়া যায়। বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মীরা গ্রামে-শহরে কাজ করিতে গিয়া নানা ধরনের বিক্ষোভের সম্মুখে পড়িয়া থাকেন, সাংবাদিকরা উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হন, পুলিশের সহিত জনতার প্রায়ই খণ্ডযুদ্ধ বাধিয়া যায়। এই সকল প্রতিকূল পরিবেশেও নানা পেশার মানুষ কাজ চালাইয়া যান। ‘আমার গায়ে হাত পড়িল কেন’ বলিয়া কাজ বন্ধ করিয়া দেন না। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে কর্মবিরতি-বিরোধী যুক্তি বহুগুণ বেশি শক্তিশালী, তাহা সকলেই জানেন। তৎসত্ত্বেও কয়েক মাস অন্তর কলকাতার নানা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণ চিকিৎসকদের ধর্মঘট এই বার্তাই দেয় যে, রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকির তুলনায় চিকিৎসকরা নিজেদের মার খাইবার ঝুঁকিকে অধিক গুরুত্ব দিতেছেন। আর জি কর হাসপাতালেই ক্যানসারের রোগীরা আউটডোরে ফ্যানের অভাবে এই প্রবল গরমে জ্ঞান হারাইতেছেন। নানা হাসপাতালে এমন চরম অসুবিধা এবং অন্যায়ের দৃষ্টান্ত অগণিত। এই সকল সমস্যার কোনও প্রতিবাদ কোনও চিকিৎসক সংগঠনের মুখে শোনা যায় না। রোগীর স্বার্থরক্ষায় হাসপাতালের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তরুণ চিকিৎসকরা গলা ফাটাইতেছেন, এমন দৃষ্টান্ত কয়টি মিলিবে? কিন্তু কিছু দুষ্কৃতীর হাতে কর্তব্যরত ডাক্তার আক্রান্ত হইলেই তাহা এক চরম সংকট বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চিকিৎসকরা লাগিয়া পড়েন। ইহার ফলে যে বার্তা পৌঁছায় তাহা এই যে, রোগী মরে মরুক, ডাক্তারকে বাঁচিতেই হইবে।
ডাক্তাররা তাঁহাদের কর্মবিরতিকে ‘আন্দোলন’ বলিয়া দাবি করিয়াছেন। শব্দটিকে এই রূপে কলুষিত না করিলেই ভাল হইত। কিছু ব্যক্তি নিতান্ত স্বার্থের খাতিরে একজোট হইয়া একটি সমাজবিরোধী কাজ করিলে তাহা ‘আন্দোলন’ হইয়া ওঠে না, তাহা ‘অপরাধ’ বলিয়াই গণ্য হইবে। এই অপরাধবোধ যে তরুণ চিকিৎসকদের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, ইহাই আজ সমাজের নিকট এক মহাসংকট। সেই কারণে রাজ্য সরকারের আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্তই বোধহয় এ ক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধান্ত। স্বস্তির বিষয়, মেডিক্যাল কাউন্সিলও এত দিনে জাগিয়া উঠিয়াছে। যাঁহারা রোগীকে বঞ্চনা করিয়া কর্মবিরতি করিবেন, তাঁহারা ‘ডাক্তার’ বলিয়া নথিভুক্তির উপযুক্ত কি না, সেই প্রশ্নটি তুলিয়াছে কাউন্সিল। উত্তর সহজ: না। |