পাঁচিল-বিতর্কে দু’ধারেই ‘রবীন্দ্রনাথ’
উপাচার্যের আর্জি শান্তিনিকেতন বাঁচান
বিবাদের কেন্দ্রে সীমানা প্রাচীর।
তার দু’পাশে দু’পক্ষ। দু’পক্ষেরই হাতিয়ার রবীন্দ্রনাথ। এর পক্ষ বলছে, রবীন্দ্র-ভাবধারাকে বাঁচাতেই এই পাঁচিল দেওয়া জরুরি। অন্য পক্ষের যুক্তি, পাঁচিল দিয়ে আসলে আটকে দেওয়া হচ্ছে রবীন্দ্র-ভাবনাকেই। এই পক্ষের যুক্তি, “রবীন্দ্রনাথ কি পাঁচিল দিয়ে খোলা হাওয়া আটকানোর কথা বলেছিলেন?” পাঁচিলের ‘মালিক’ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ আবার রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেই ‘পবিত্রতা’ রক্ষার কথা বলছেন। তাঁদের যুক্তি, “অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন অন্তত ‘বাফার জোন’ বাঁচাতে হবে।”
বিশ্বভারতীর এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরার কাজ শুরু হয় প্রাক্তন উপাচার্য সুজিতকুমার বসুর আমলে। রজতকান্ত রায়ের আমলে তা গতি পায়। নিন্দুকেরা আড়ালে ‘পাঁচিল কাকু’ বলে ডাকতেন। ওয়েবসাইটেও ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিবাদ। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তের কথায়, “নোবেল চুরির পরে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম শান্তিনিকেতনে এসে জানতে চেয়েছিলেন, পাঁচিল নেই কেন। নিরাপত্তার কারণেও এটা দরকার।”
সেই সীমানা প্রাচীর নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। পাঁচিল দেওয়ার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। পাঁচিল-বিবাদে থানা-পুলিশ পর্যন্ত হয়েছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ‘তিক্ততা’ বেড়েছে এলাকার অনেক বাসিন্দার। বিকল্প রাস্তা তৈরির চেষ্টা অবশ্য করছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রশ্নটা হল, পাঁচিল তুলে বিশ্বভারতীর রাস্তায় ট্রাক-লরির মতো পণ্যবাহী ভারী গাড়ি চলাচল বন্ধ করা গেলেও চারপাশের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘিরে ফেলা আইনি-বেআইনি নির্মাণের কী হবে?
বিশ্বভারতীর দেওয়া পাঁচিল। আশ্রম মাঠের পাশে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
বিশ্বভারতীর নিজস্ব আইন তো বটেই, শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদের (এসএসডিএ) বিল্ডিং আইনেও বলা আছে, ওই সব এলাকায় ৮.৫ মিটারের (দোতলা) বেশি উঁচু বাড়ি করা যাবে না। এসএসডিএ কর্তাদের দাবি, তাঁরা কখনওই দোতলা বাড়ির বেশি অনুমোদন দেন না। তা হলে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের লাগোয়া গুরুপল্লি-সীমান্তপল্লিতে চার তলা কী ভাবে বাড়ি উঠেছে? বোলপুর পুরসভার চেয়ারম্যান সুশান্ত ভকত বললেন, “পুরসভার আইনে ১৪.৫ মিটার উঁচু বাড়ি তৈরির অনুমতির কথা বলা আছে। অনুমতি না পেলে লোকে আদালতে যাবে।”
পাশাপাশি এলাকা, অথচ এক এক সরকারি সংস্থার এক এক নিয়ম! আর এর ফাঁক গলেই উঠে এসেছে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ। শান্তিনিকেতনে গত এক দশকে প্রোমোটারি ব্যবসায় যিনি ভাল নাম করেছেন, সেই হাজি আফসার আলি বললেন, “গুরুপল্লিতে ২০ বিঘা জমি প্লট করে বেচেছি। মোট ৬৪টা প্লট।
এর মধ্যে ১৬ কাঠা জমিতে ফ্ল্যাট হচ্ছে ৩৬টা।” আবার তিনিই বলছেন, “পরিবেশ খারাপ করব না বলেই বিশ্বভারতীর লোককে প্লট বিক্রি করেছি। তাই যদি কেউ বিশ্বভারতীর গরিমা, ঐতিহ্য, পরিবেশ নষ্ট করে থাকে, তার দায় ওঁদেরই।”
পুরসভা, এসএসডিএ এবং স্থানীয় মানুষের প্রশ্ন, বিশ্বভারতী চত্বরেই চার-পাঁচ তলা বাড়ি উঠছে কোন আইনে? এটাও ঘটনা। অস্বীকার করার উপায় নেই।
এমনই এক পরিস্থিতিতে মাত্র আট মাস আগে দায়িত্ব নিয়েও ইমারতের জঙ্গল থেকে ‘বাফার জোন’কে বাঁচাতে উদ্যোগী হয়েছেন বর্তমান উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত। কোনও বিরোধে না গিয়েও একটু কড়া হাতেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চান তিনি। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মডেল’ করে বিশ্বভারতীও যাতে ‘শিক্ষা-নগরী’-র মর্যাদা পায়, তার জন্য উপাচার্য দরবার করবেন কেন্দ্রের কাছে। শান্তিনিকেতন থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে সিউরি রোডের পাশে মৌলডাঙায় প্রায় ১০০ একর জমিতে বিশ্বভারতীয় নতুন ক্যাম্পাস তৈরির পরিকল্পনারও কথাও শুনিয়েছেন উপাচার্য।
সুশান্তবাবুর আমলেই বিশ্বভারতীর রেজিস্ট্রার রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি দিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন। বীরভূমের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়েও রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, বিশ্বভারতী লাগোয়া কোন কোন প্লটে নির্মাণ হয়ে গিয়েছে অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে প্রোমোটার। কোথায় এসএসডিএ-র আওতাধীন জমিতে নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে পুরসভা। এ সবের ভিত্তিতে মুখ্যসচিব জরুরি বৈঠক করে জেলা প্রশাসনকে কিছু নির্দেশ পাঠিয়েছেন। রাজ্যের পুরসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সই করা সেই নির্দেশে বলা হয়েছে: বোলপুর পুরসভা ও লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকায় সমস্ত বেআইনি নির্মাণ ভেঙে দিতে হবে। বিশ্বভারতীর লাগোয়া কোনও জমিতে নির্মাণের অনুমতি দিতে হলে পুরসভাকে এসএসডিএ এবং বিশ্বভারতীর অনুমোদন (এনওসি) নিতে হবে। ওই এলাকা দখলমুক্ত করতেও প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এসএসডিএ এবং পুরসভার অভিযোগ, ‘বাফার জোন’ লাগোয়া প্লটের কোনও তালিকা দু’বছরে দিতে পারেননি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। সমস্যা সমাধানে সদিচ্ছার অভাবের অভিযোগও তুলেছে তারা। সব পক্ষের সহযোগিতা চেয়ে উপাচার্য অবশ্য বলছেন, “শান্তিনিকেতনকে বাঁচান। অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। তবু এখনও বাফার জোনটাকে রক্ষা করার সুযোগ রয়েছে।” বিতর্কিত এলাকার দুই কাউন্সিলর জাহাঙ্গির হোসেন ও দীপা মাঝিও মনে করেন, সহমতের ভিত্তিতেই সমাধানের পথ খোঁজা উচিত। কারণ, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকে তো বাঁচাতে হবে!
বাঁচাতেই হবে। কাজটা কঠিন। অসম্ভব নয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.