পরিবেশের ভাল মন্দ ভাবতে গেলেই কি, খুব রাশভারী, চিন্তাশীল ধরনের ভাবমূর্তি বানাতে হয়? অষ্টপ্রহর গাছপালা, জীবজন্তুর জন্য এত এত চিন্তিত যে নিজের দিকে কোনও নজর নেই। দু’দিক বজায় রাখা যায় কিন্তু। সুন্দর পোশাকে সবার তারিফ কাড়লেন, ও দিকে সে সব পোশাকে খানিকটা প্রকৃতির সেবা করাও হয়ে গেল। এই ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি ফ্যাশন’ বিষয়টি নিয়ে একটু ভুলভাল ধারণা ভাসে। কেউ ভাবে, গ্রিন ফ্যাশন মানে ফুল-পাতার মুকুট পরে, গাছ বা পাখি সেজে র্যাম্পে হাঁটা। আবার অনেকে গ্রিন ফ্যাশন শুনলেই নাক কুঁচকোন। ম্যাড়মেড়ে, ও দিয়ে সাজগোজ হয় না। কিন্তু, প্রতি দিন ব্যবহারের জন্যও প্রচুর গ্রিন ক্লোদিং পাওয়া যায়। দেখতে ভাল, উদ্দেশ্যও ভাল। মজবুত পরিবেশবান্ধব ফেব্রিক দিয়ে তৈরি। ছেঁড়ে না, সহজে রং ওঠে না। দু’মাস অন্তর শপিং লিস্ট বানানোর কোনও প্রয়োজনই নেই। এই জন্যেই তো এই সব পোশাকের আর এক নাম ‘সাস্টেনেবল ফ্যাশন’। |
জামার ওপর কয়েকটা গাছের ছবি বা পরিবেশ বিষয়ে দু’টো কথা ছাপা থাকলে সেটা শুধুই ফ্যাশন। পরিবেশ বান্ধব পোশাক খুঁজতে আরও একটু গভীরে যেতে হবে। একটু ভেতরের ট্যাগে ‘অর্গ্যানিক কটন’ কথাটা খুঁজুন তো। ওই দু’টো শব্দ থাকা মানে, এই তুলোর চাষ করার সময় কোনও রকম কীটনাশক ব্যবহৃত হয়নি। পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে, এমন কিছুই সেই চত্বরে ঢুকতে পারে না। এক দিক দিয়ে ওই পোশাক পরে যেমন প্রকৃতিদেবীকে খুশি করলেন, তেমনি আপনার স্বাস্থ্যটাও বাঁচল। পোশাকে ওই সব কীটনাশক পদার্থ থাকলে, শরীরটা কি আর রেহাই পেত? তা ছাড়া, সবাই মিলে এই সব প্রাকৃতিক পোশাক পরলে দেশের কৃষি ও অর্থনীতিটাও আরও জোরদার হবে। জৈব তুলো থেকে তৈরি ফেব্রিক দেখতেও বেশ মোলায়েম। ক্রিম, ফিকে সবুজ, হালকা খয়েরি। দেখে নিন রংটাও ভেজিটেবল ডাই করা কিনা।
রেশমি কাপড়ের দেখনাই নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আর এ পোশাক রেশমকীটদের কারখানায় একেবারে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হয়। তাই গ্রিন ফ্যাশন হওয়ার প্রায় সব নিয়মই অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। শুধু, এতে রেশম কীটদের ওপরে একটু অত্যাচার হয়। বেচারাদের গরম জলে ডুবিয়ে রেশম তন্তুগুলো আলাদা করা হয়। তাই এখন নতুন এসেছে ‘পিস সিল্ক’। এ ক্ষেত্রে মথ চলে যাবার পর, ছেড়ে যাওয়া গুটি থেকে সিল্ক বার করা হয়। পিস সিল্ক কিন্তু ভীষণ হালকাও। কলকাতার গরমে খুব আরামদায়ক।
লিনেনের শার্ট ট্রাউজার্স বা অন্যান্য পোশাক এখন দারুণ নাম করেছে। পরলে ফ্যাশনেবল আখ্যা তো পাওয়াই যায়, সঙ্গে পরিবেশরক্ষার দায়িত্বটাও মেটে। খাঁটি লিনেন কাপড় তৈরি হয় তিসি থেকে। আর এই শস্যের ফলনে তেমন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। তাই প্রকৃতিও থাকে নিরাপদে। লিনেনের পোশাক একটু কুঁচকে কুঁচকেই থাকে। বেশি ইস্ত্রি করার প্রয়োজন হয় না। তাই শক্তিও বাঁচে তবু, লিনেন পোশাক কেনার আগেও ‘গ্রিন সার্টিফিকেট’দেখে নিন।
কাশ্মীরের পশমিনা শাল, সোয়েটারও পরিবেশের কোনও ক্ষতি করে না। এই তন্তু পশমিনা ছাগলের লোম কেটে তৈরি হয়। সে লোম ক’দিনেই বেড়ে যায়। তাই পশুর প্রতি অবিচারের অভিযোগও নেই। তবে পশমিনার একটা কম দামী সংস্করণও পাওয়া যায়। সেটায় কিন্তু কিছু অন্য তন্তু, কৃত্রিম রংও মেশানো থাকে। পরিবেশের প্রতি খুব একটা সদয় হয় না। তার থেকে একটু দাম দিয়ে আসল পশমিনাটাই কিনুন। সারা জীবন সঙ্গে থাকবে।
তবে আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী ডেনিম কিন্তু পরিবেশরক্ষায় ডাহা ফেল করবে। ডেনিম ট্রাউজার্স, স্কার্ট, শার্ট সব কিছু তৈরি করতেই প্র-চু-র জল নষ্ট হয়। তবে, বেশ কিছু ডেনিম ব্র্যান্ড পরিবর্ত কিছু পদ্ধতি খুঁজেও ফেলেছে। তাতে ডেনিম প্রস্তুতির সময় জলের অপচয় অনেক কমেছে। এ ধরনের ওয়াটারলেস ডেনিম-এ কিন্তু কাট বা রঙের কোনও তফাত বোঝাই যায় না গ্রিন সার্টিফিকেট পাওয়া পোশাক এখনও বেশ কম। যা আছে, বেশির ভাগটাই সিনথেটিক কাপড়ে তৈরি। নন প্রেস শার্ট, অ্যাক্রিলিকের জুয়েলারি, নাইলনের জ্যাকেট সব সুন্দর জিনিসের অন্তরালেই অভিশাপ লুকিয়ে। প্রকৃতিকে দূষিত করে তোলার ফলটা যে কী, সে তো ছোট্টবেলা থেকেই জানি। |
গ্লোবাল ওয়ার্মিং, শ্বাসকষ্টে ভোগা একটা কালচে শহর, যখন-তখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সে সব লাগাতার দেখছিও চোখের সামনে। মুষড়ে না পড়ে আয়ত্তের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটা করলেই হয়। এই গ্রিন ফ্যাশন কথাটায় একটু গুরুত্ব দিলে, সামান্য হলেও একটু উজলা হবে পরিস্থিতি। আমরা ক্রেতারা যদি বারবার গ্রিন সার্টিফিকেট দেখে, ন্যাচারাল ফেব্রিক বাছাই করে পোশাক কিনি, পোশাক নির্মাতারাও নড়ে-চড়ে বসবে। তখন নিশ্চয়ই পরিবেশকে বাঁচিয়ে পোশাক তৈরির কথাটাও তারা একটু বেশি ভাববে। তখন আরও অনেক রকম পরিবেশ বান্ধব পোশাক পাব আমরা। তার পর আমরাও সুন্দর থাকব, আর আমাদের পৃথিবীটাও সুন্দর থাকবে। আসবে তো সে দিন? |