‘জল পাই’-এর বড্ড চাহিদা
পৃথিবীর সব থেকে বৃষ্টিবহুল অঞ্চল ম্যাপ পয়েন্টিং এলেই, এক সময় সারা ক্লাস মিলে মেঘালয়ের ওপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ত। বৃষ্টির ফোঁটা এঁকে, ঘন নীল রং ঘষে ঘষে কাগজের চেরাপুঞ্জিকে প্রায় চিরে ফেলার উপক্রম। ইজি কোশ্চেন, ওইটে অন্তত কেউই ভুল করত না। কিন্তু ভুলটা খোদ চেরাপুঞ্জিই করে বসল। অমন আদিম আদিম আমেজওয়ালা জায়গাটাকে শহর বানানোর ভূত চাপল মাথায়। ব্যস, গাছগুলোকে নির্বংশ করার ধুম পড়ে গেল। এ দিকে, এমন যে বৃষ্টি আর বৃষ্টি, কিন্তু সেই জলটা ধরে রাখার, তাকে কাজে লাগানোর কোনও ব্যবস্থাই হল না সেখানে। ফল? দারোগার বাড়িতে ডাকাতি! খোদ চেরাপুঞ্জিতেই খরা! ভূমিক্ষয়! জলাভাব!
এ বার ভারতের ম্যাপের পশ্চিম ধারটায় চলে আসুন। ধূসর হলদে রং, কাঁটাগাছ, থর মরুভূমি। তারই মধ্যে একটা রাজস্থানি গ্রাম। সেখানে সবেধন নীলমণির মতো, ধুঁকতে ধুঁকতে বইছে রুপারেল নদী। তার চার পাশের এলাকায় যা বৃষ্টি হয়, তা চেরাপুঞ্জির ধারেকাছেও যায় না। কিন্তু, যতটুকু হয়, ভুক্তভোগী মানুষগুলো তার সদ্ব্যবহার করতে জানেন। সেই সংরক্ষণের সুবাদেই আজ তাঁদের ঘরে ঘরে চেরাপুঞ্জির থেকে ঢের বেশি জলসম্পদ।
মুশকিল হল, ক্রান্তীয় দেশ হওয়ার সুবাদে আমাদের কপালে জুটেছে আর্দ্র গ্রীষ্ম (পড়ুন ভ্যাপসা, ছাতিফাটা গরম), শুষ্ক শীত। তাই, ভারতের বহু অঞ্চলেই জলকষ্টটা বরাবরই মারাত্মক। ও দিকে চাষবাস, শিল্প যা-ই করতে যাও তার জন্য তো গ্যালন গ্যালন জল দরকার। দেখুন, খাতায়-কলমে ভারত যতই মৌসুমি বায়ুপুষ্ট, নদীমাতৃক দেশ হোক, সে সব জলের পুরোটা মোটেও ব্যবহারযোগ্য নয়। গোটা পৃথিবীর তিন ভাগ জলের ৯৭ শতাংশই সাগরের লোনা জল, অর্থাৎ, তা কোনও উপকারে আসে না। বাকিটার অনেকটাই আবার বরফ, অর্থাৎ সেটাও বাদ গেল। মাত্র এক শতাংশ হল পানীয় জল। অঙ্ক করলে দেখা যায় ‘ফ্রেশ ওয়াটার’, অর্থাৎ যেটা কিনা মানুষ কাজে লাগাতে পারে, সেটা আসলে দুই শতাংশেরও কম। এ তো দুনিয়ার হিসেব দিলাম। এ বার পৃথিবীতে যদি এত হয় তবে ভারতে কতটা শুদ্ধ জল আছে, সেটা ত্রৈরাশিক কষে বের করে ফেলুন। ভগ্নাংশেরও তস্য ভগ্নাংশে কিছু একটা আণুবীক্ষণিক উত্তর বের হবে।
পরিস্থিতিটা যে কত সঙ্গিন, আমাদের পূর্বপুরুষরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন। নগর পরিকল্পনায় সিন্ধু সভ্যতা তো যে কোনও যুগে ফুল মার্কস পাবে। সিন্ধু নদী থেকে খাল কেটে নাকি গোটা শহরে জল বিলি করা হত। কতটা জল বাঁচিয়ে ফেললে, ও রকম একটা মেগা আয়তনের ডিলাক্স চানঘর বানানো যায়, ভেবে দেখুন। এ বার ইতিহাসে কয়েকটা লাফ দিয়ে মুঘল আমলে ঢুকে পড়ুন। এই পুণে-গুজরাটের দিকটায়। পশ্চিমঘাট পাহাড় ঘেঁষে, পাথর পাহাড় কেটে বৃষ্টির জল ধরে রেখে বিরাট বিরাট দিঘি বানিয়েছিলেন রাজামশাইরা। রাজস্থানও তো কম যেত না। খরাবিধ্বস্ত মরু অঞ্চলে বাড়ির ছাদগুলো বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি করা হত। বৃষ্টি হলে, জল ছাদের ঢাল বেয়ে নেমে মাটির তলার লুকানো পুকুরে গিয়ে জমা হত।
ইদানীং দিল্লিও সেই পথেই চলছে। পরিত্রাহি গরম ও আত্মাকাঁপানো ঠান্ডা থেকে বাঁচতে রাজধানীর অনেক বাড়িই বিশেষ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। তার ছাদেই বিশাল বিশাল ট্যাঙ্ক থাকে। সেখানে বৃষ্টির জল মজুত হয়। কোথাও কোথাও সেই জল পাইপ দিয়ে ভূগভের্র জলাধারেও পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিটা নতুন বাড়ির নকশাতে এই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতেই হবে ভারতে সবার আগে আইনটি বলবৎ করেছিল বেঙ্গালুরু পুরসভা। কর্নাটকের গ্রামাঞ্চলেও সচেতনতা অভিযান চলছে। গ্রামে কূপ, পুকুর, নালা খুঁড়ে বর্ষা আটকে রাখাই যায়। কিন্তু সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার, জমা জল পরিশোধিত করে, নানা প্রয়োজনে ব্যবহার করতেও জানতে হয়। নইলে গোটা পরিশ্রমটা জলেই যাবে। সেই সব শেখাতেই শিবির বসছে নিয়ম করে। গাড়োয়ালে বৃষ্টি হলেই মাটি ধুয়ে যায়, ওই মাটি যে জলটা ধরে রাখতে পারত, তাও যায় হারিয়ে। গাড়োয়ালের মেয়েরা চ্যালেঞ্জটা নিয়েছেন। পাহাড়ের ঢালে গভীর গর্ত কাটছেন তাঁরা, বর্ষায় সে গর্ত জলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। মাটি জল টেনে নিলেই আবার ঝুরো মাটিতে গর্ত বুজিয়ে দিতেই মার দিয়া কেল্লা। সেই মাটির সঙ্গেই জলও আটকে যায়। সেই জলে ঘাস লাগালে আরও জল জমতে থাকে। এ ভাবেই জলস্তর বাড়ছে ওখানে। আর, সাগরপারের লোকজন তো প্রকৃতিটাকেই পালটে ফেলেছেন। যজ্ঞের বদলে বৃক্ষরোপণ করলে বৃষ্টিদেবতা বেশি কথা শোনেন, তা ওঁরা বিলক্ষণ জানেন। এবং জানেন, যেখানে জলটা জমাবেন, তার চার পাশে গাছ পুঁততে হয়। গাছের গায়ে হাওয়া বার বার ধাক্কা খাবে, চটজলদি জমা জল শুকিয়ে দিতে পারবে না। এই কায়দায় ‘বাষ্পীভবন’কে অনেকখানি আটকে রেখেছেন ওঁরা। বৃষ্টির জলে মিহি মাটি ধুয়ে যায় বলে, ঢালু জায়গার গায়ে কাদাপাথর দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকার দেওয়াল বানাচ্ছেন, ক’বছর বাদেই সে দেওয়াল পাঁচিল হয়ে উঠছে। তখন সেখানে গাছ পুঁতে দিচ্ছেন। ওটাও তো একটা ঢাল। ফলে, বৃষ্টি যখন আসছে, তখন অনেকটা বেশি জল ধরে রাখতে পারছেন ওঁরা।
বিদেশ দৌড়চ্ছে, পাশের রাজ্যের লোকজনও এগিয়ে গেছে অনেক। আমরা? নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। কয়েকটা হাউজিং সোসাইটিতে ‘জল বাঁচাও, জল জমাও’ ধরনের কাজকারবার চলছে ঠিকই। কিন্তু, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হয়, তাই দিয়ে রান্না-খাওয়া, ঘরের নানা কাজ চলে কলকাতার আশেপাশেও এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেলে তো ব্রেকিং নিউজ, ফেসবুকে শেয়ার করার ছবি। যদি পাইও, পটাপট লাইক মেরেই ভুলে যাব। ‘গ্রিন বিল্ডিং’ কথাটা শুনলে ‘ও তো বিদেশে হয়’ বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব। তার পর দিন, সকাল দশটায় রাস্তায় বেড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে উঠব। ‘এ তো জ্যান্ত ঝলসে দেবে রে! বৃষ্টি এ বারও দেরি করবে? কেন?’ আর কেন? ঝমাঝমঝমঝম বৃষ্টি থইথই জলস্তর রোদের তেজে জল শুকিয়ে বাতাসে মেঘের জন্ম আবার বৃষ্টি এই চক্রটা তো আমরাই বিগড়ে দিয়েছি। বনজঙ্গল গিলে খাচ্ছি, তেড়ে জল নষ্ট করছি লাগাতার। সেই দুই শতাংশের জলস্তর, আমাদের দাপটে রোজ রোজ আরও আরও কমে যাচ্ছে। এর পর মৌসুমি বায়ু কোত্থেকে জল যোগাড় করে আনবে, বলতে পারেন?
তবু এ বারও রিমঝিম রুমঝুমরা আসবে। এলেই এই বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী-জ্যৈষ্ঠের ফুটন্ত দিনগুলো স্মৃতি থেকে স্রেফ তাড়িয়ে দেব। আবার নাগাড়ে ঘ্যানঘ্যান ‘কাদা, পচা জল ভর্তি কলকাতা চাই না। বাড়ি বন্দি থাকব না আর। রেন রেন গো অ্যাওয়ে, প্লিজ।’
আর বৃষ্টির জলধারাও অঝোরে কাঁদবে। ‘আজ না হয় তোমাদের বাড়ির ছাদ ফুটো করে আর জল ঝরে না। তবু, আমাকে ধরে রাখ কলকাতা, প্লি-ই-জ। নইলে...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.