প্রথম রেনি ডে
শরীর শিউরে উঠে আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নিই। সেখানে হিংস্র বেগুনি রঙের টুকরো টুকরো কালোর পোঁচ পড়ছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়। বাতাস নির্ভুল ভাবেই নিথর। তিরুঅনন্তপুরম থেকে কোভালমে আসতে হলে এই উঁচু টিলার মাথায় চড়তেই হয়। যত দূর চোখ যায় তত দূরেই সবুজে মিশেছে হলুদ। ঘরবাড়ি, হাইওয়ের মার্কিং, চার্চের ক্রস সমস্তই আরও কালো হয়ে ওঠা আকাশের নীচে আরও চোখ রাঙানো সাদা। মগডাল ছেড়ে পাহাড়ের পোক্ত খোঁদলের খোঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে সিগাল। স্পষ্ট মনে হচ্ছে, আমার পায়ের নীচে যে মাটি, তা আসলে কোনও চরভূমির। পাতালফোঁড় মন্ত্রের মতো যে শব্দ হালকা দোলাচ্ছে মাটিকে, তা নামাজের হতে পারে, জাহাজেরও হতে পারে। বুঝতে পারি, যে দেখছে সে আমি নয়, যা দেখছি তা আমার নয়। আসলে তখন সমস্ত বোধগম্য ও বোধবহির্ভূত দৃশ্য নিঃসন্দেহে কোনও দৈব নির্দেশে জেগে উঠছিল, ছিঁড়ে যাচ্ছিল। প্রত্যেক বছর, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে, মাত্র কয়েক মিনিট চরাচরব্যাপী এই দৃশ্যবিচ্যুতি ঘটিয়ে প্রথম বৃষ্টি আছড়ে পড়ে ভারতের মাটিতে। এই প্রথম ঝাপট, বা সাহেবরা যাকে বলেছে ‘ফার্স্ট সার্জ’, ধর্মের মতোই তার তীব্রতা বুকে সইতে শিখেছে কেরল। ঠেকেই শিখেছে।
ঈশ্বরপ্রেরিত এই সেই মুহূর্ত যখন নোঙরফেলা দূরজাহাজে চিমনির ধোঁয়া একটুও না ভেঙে মোটা সুতোর দাগ টেনে যায় দিগন্তের সমান্তরালে। এই বিশেষ মুহূর্তটাকে ব্রিটিশরা চিনত, তাই কোভালমের কাছে টিলার মাথায় তাদের প্রথম আবহাওয়া কেন্দ্র খুলে, টেলিস্কোপে চোখ রেখে, ব্রিটিশরা নজর রাখত কত দূর এগিয়ে এল দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। পরিযায়ী পাখির মতো এক্কেবারে একই রুটে কোভালমে হানা দিতে এই বাতাসের সময় লাগে ৫ থেকে ১৫ দিন। বাকিটা এই বিশাল দেশের প্রতিটি মানুষের বর্ষার সঙ্গে আশা নিয়ে ঘর করা। এই ‘মনসুন’ কার্জনের গঠনধর্মী সাম্রাজ্যবাদ থেকে মনমোহনোমিক্স সব কিছুরই জিয়নকাঠি। হরি রাখলে রাখেন, ডোবালে ডোবান। তাই কি হরির গায়ের রং নবজলধরশ্যাম?
কোভালম বাসস্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তাটা সমুদ্রের দিকে গেছে, তা ওই সদ্য বিকেলেই গাঢ় ছায়াচ্ছন্ন। দু’দিকে মহার্ঘ হোটেলগুলোয় তকমা আঁটা বেয়ারারা অতি ব্যস্ততায় সমুদ্রমুখী কাচের দেওয়াল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে পর্দা। প্রকাণ্ড ডাইনিং হলে নিরাপদ, স্বচ্ছ দেওয়ালের নাক ঘেঁষে সাজিয়ে ফেলা হয়েছে সারি সারি ডেকচেয়ার। টি-পট-এ হড়কানো আলোয় হরেক সাহেবসুবোর মুখে আকাশের বেগুনি আভা। চারিদিকে তাকালে কেমন একটা অ্যাম্ফিথিয়েটারের বিভ্রম হয়। সিংহ এবং গ্ল্যাডিয়েটরের মাঝখানে আমি তৃণবৎ মধ্যবিত্ত, অল্প খুচরো টাকা প্লাস্টিকে মুড়ে এরেনায় নেমেছি। দু’দিক দিয়ে স্রোতের মতো সমুদ্রমুখী চলেছে স্কুলের বাচ্চারা। কেরলের প্রত্যেক স্কুলের ইউনিফর্মই বোধ হয় আকাশি। তা আপাতত, মৌসুমি বর্ণবিপর্যয়ে, ঈষৎ গোলাপি মনে হচ্ছে, সামনে কালিগোলা সমুদ্র। আমার ডান দিকে নারকেল গাছের সারি, বাঁ দিকে হোটেলের। অজস্র মানুষের ‘কমব্যাটিভ পজিশন’ গাছের গুঁড়ির আড়ালে, কিংবা থামের পিছনে। এক ঝাঁক স্কুলপড়ুয়া হুল্লোড় করে বালিতে নামতে গিয়ে লাইফগার্ডদের প্রচণ্ড তাড়া খেল। নির্দিষ্ট দূরত্বে পাড় বাঁধানো বোল্ডারের ওপর দিয়ে লাইফগার্ডরা তৈরি করেছে লক্ষ্মণরেখা, তার ও পারে যাওয়া নিষেধ। বাচ্চাগুলো একটুও দমল না যদিও। বিশাল বিশাল দল পাকিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগল যত্রতত্র।
কেরলে মৌসুমি বায়ুর আগমনের দিনটা, অফিশিয়ালি, ১ জুন। প্রত্যেক স্কুলে নতুন সেশনটাও শুরু হয় এই দিন। এ-ও ওই রাজ্যের এক বরিষণ-সংস্কৃতি প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন শিশু যেন বৃষ্টিতে ভিজতে শেখে। মেঘ ঘনিয়ে এলে বই-খাতা ক্লাসরুমে রেখে ভিজতে বেরিয়ে আসা এ রাজ্যে এক রকম আবশ্যিক। ১ জুন প্রত্যেক দৈনিকেরই হেডলাইন হয় ঠিক ক’জন শিশু ওই দিন প্রথম স্কুলে যাবে। আর প্রথম স্বাধীন হয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে।
তৈলাক্ত সমুদ্রে গড়িয়ে আসা ঢেউয়ের মাথায় ফিনকি দিয়ে উড়ছে ফেনা। বাতাসের জোর বাড়ছে। ডমরু গুরুগুরু সমুদ্রের সমতলে। অবিরত। আদ্যন্ত কানির্ভাল অ্যাটমোস্ফিয়ারে উপরে তাকিয়ে খুঁজি নাগরদোলার শিখর। দেখি বাতিঘরের আলো এগোতে পারছে না আকাশ ফুঁড়ে। হঠাৎ নীল-সাদা ডোরাকাটা এক প্রকাণ্ড পর্দাকে দিগন্ত ছেয়ে এগিয়ে আসতে দেখি। ওই কি বহু যুগের ও পার? কুমিরের ক্ষিপ্রতায় বিচটাকে পেরিয়ে এসে সজল ঢেউ ধাক্কা মারল পাড়ে। ছিটকে ওঠা ফেনায় সামনেটা যখন অস্বচ্ছ, ঠিক তখনই বৃষ্টি ধরে ফেলল আমাদের। নির্মম ভাবে। প্রথম ধাক্কাতেই বসে পড়লাম হাঁটু গেড়ে। বেতমিজ ক’জন, যাঁরা ছাতা মেলছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককেই হামাগুড়ি দিতে দেখা গেল। ফুলের পসরা মাথায় দক্ষিণী মালিনী আবছা দৌড়ে গেল। জেলেদের জেটিতে ফ্রান্সিস্কান চার্চের ঘণ্টার দড়িটা মাতালের মতো টেনেই চলেছে কেউ। অপার্থিব বিস্ফোরণ ঠেকাতে চেয়েছিল নারকেল বন, স্রেফ বিধ্বস্ত হয়ে বৃষ্টির ধোঁয়ায় মুছে গেল। কাচ ভাঙল, বাহারি টালি ছাওয়া ছাদ কেঁপে উঠল বার বার। সমস্ত শরীর পেতে চেয়ে নেওয়া প্রলয়ের আঘাত এর চেয়েও মহৎ সমর্পণ আর কি থাকতে পারে কিছু?
বৃষ্টি ও হাওয়ার ধাক্কায় টলতে টলতে নিজের অজান্তেই সরে এলাম। সমস্ত আলো নিভিয়ে একটা গ্রাম থর থর করে কাঁপছে। জেলেদের জেটিতে পৌঁছবার আগে বাঁ দিকে প্রকাণ্ড সাদা মসজিদ। কেরলে নির্ভেজাল সফেদ রেস্তোরাঁ বা মসজিদ দেখলেই বুঝতে হবে এর পিছনে রয়েছে গালফ-এর ও পারের দেশগুলোর আয়েশি টাকা। প্রত্যেক পরিবারেরই কেউ না কেউ রোজগারের ধান্দায় পাড়ি দিয়েছে আরব দুনিয়ায়। ইতিহাসের এ এক উল্টো স্রোত। কারণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বাতাসকে প্রথম চিনেছিল আরবরাই। ওরাই প্রথম শিখিয়েছিল বছরের বিশেষ সময়ে ভারতীয় উপকূলের দিকে ধেয়ে যাওয়া জলজ ভারী বাতাসকে পালে ধরে রেকর্ড সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কোচিন-কালিকট-কুইলন-ক্যাম্বি। ক’মাস ঊর্ধ্বশ্বাস বাণিজ্যের পর ভারতীয় পণ্যে জাহাজ বোঝাই করে আবার ওই হাওয়ারই ফিরতি টানে আরবরা ঘরমুখো হত। গভীর সমুদ্রে ভারী বাতাসের সঙ্গে যুঝবার জন্য আরব দুনিয়ায় তৈরি হত খুব সরু আর অনেকটা লম্বা এক ধরনের জাহাজ। এই জাহাজের নাম ‘ধাও’ (dhow)। ওই একই জাহাজ আমাদের গুজরাতে তৈরি হত, এখনও হয়। কার পেটেন্ট যে কে মেরে দিয়েছিল, বলা শক্ত। তবে, ‘মনসুন’ শব্দটার উৎস কিন্তু আরবি।
এই মৌসুমি বাতাস রোমানদের চেনায় আরবরাই। এই বাতাসকে যারা চিনত, অর্থাৎ, আরব-রোমান-ভারতীয় বণিককুল, তাদের মধ্যে একটা মন্ত্রগুপ্তির ব্যাপারও নিশ্চিত ভাবে ছিল। বাকি পৃথিবী ছিল অন্ধকারে। তার পর এক দিন, ১৪৯৮ সালে, কালিকটে ভিড়ল ভাস্কো-দা-গামা’র জাহাজ। চালিয়ে আনল এক গুজরাতি নাবিক। দা-গামা লিখলেন, ওই নাবিক এক জোরালো হাওয়ার খেয়ালখুশি বুঝত, যে হাওয়াকে বলে ‘মনসাও’। লিসবনে ফিরে জাহাজ বোঝাই মশলাপাতি বেচে দিলেন দা-গামা। প্রফিট মার্জিন ছ’শো শতাংশ। পরের ইতিহাস অনিবার্য। সমস্ত রহস্যময়তা হারিয়ে ফেলল মৌসুমি বাতাস।
অঝোর বৃষ্টির পরদা দু’হাতে সরিয়ে মসজিদে ঢুকছে নামাজির দল। প্রত্যেক শরীরে লেপটে আছে বৃষ্টি। দমকা হাওয়ায় কেঁপে উঠতে উঠতে আমি আবারও পারিপার্শ্বিকের বোধ হারিয়ে ফেলি। দেখি, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার অল্প দূরত্বেই কালিকটের সমুদ্রে নোঙর ফেলেছে তিনটে জাহাজ। সালটা ১৩৪২। মহম্মদ বিন-তুঘলকের লোক-লশকর দৌত্য করতে চলেছে চিনে। চিনা সম্রাটের ভেট হিসেবে বড় দুই জাহাজে বোঝাই হয়েছে একশো ঘোড়া, কিংখাব, রত্নখচিত দস্তানা-আলখাল্লা, একশো ক্রীতদাস। ছোট জাহাজটায় রয়েছে নাচেগানে তুখোড় একশো হিন্দু দেবদাসী। চতুর্দিকে থমথমে বিকেলের আলো। ছোট্ট একটা কার্পেট বগলে নিয়ে সৈকতে নেমে এলেন লিডার অব দ্য ডেলিগেশন ইবন বতুতা। সতেরো বছর আগে মরক্কো ছেড়েছিলেন, বয়স তখন একুশ। গোটা দুনিয়া হেঁটে পেরিয়ে এসে পৌঁছেছেন দিল্লির দরবারে। পাগলা সুলতানের বদান্যতায় দিল্লির কাজি হয়ে বহু বছর ধরে দিব্যি গাছের খেয়েছেন, তলার কুড়িয়েছেন। বছরখানেক রাজকর্ম ছেড়ে এই ইসলামজ্ঞানী পিরসঙ্গ করছিলেন। হঠাৎ চিন যাওয়ার ডাক আসতেই মুসাফির রক্ত উঠল ছলকে। তবে পোড়খাওয়া বতুতা বুঝেছিলেন, ভারত ছেড়ে এটাই তাঁর চিরতরে চলে যাওয়া। তাই শেষ বারের মতো ভারতের মাটিতে নামাজ পড়তে জাহাজ থেকে নেমে এসেছেন।
ঠিক তখনই ভাঙল আকাশ। ‘ফার্স্ট সার্জ’-এ বড় জাহাজ দুটো ছিটকে পাড়ে উঠে ধাক্কা খেল পাহাড়ে। চুরমার হয়ে গেল। আর নোঙর ছিঁড়ে ছোট জাহাজটা ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেল দরিয়ায়। একশো দেবদাসী বুকে নিয়ে।
দিল্লি ফেরেননি আর ইবন বতুতা। ওই জাহাজটা খুঁজতে খুঁজতে আর হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ফিরে এলেন ঘরে। মরক্কোয়। বারোটা বছর কেটে গিয়েছে তত দিনে। একশো দেবদাসীর একশো বায়না একলা মুসাফিরের শরীরে একশো বৃষ্টির ফোঁটায় ঝরে পড়েছিল কি না, সে কথা ইবন বতুতা কখনও লেখেননি।
আশরীর ভিজে গিয়ে জাহাজটার জন্য, এই প্রথম, অল্প মন খারাপ হয়। বৃষ্টির ও পারে সমুদ্রের বুকে তাকাতে ইচ্ছে করে হঠাৎ। রাত্রি নামছে। আকাশে বাতিঘরের উন্মোচক আলো।
একশো দেবদাসী কখনও কি কোনও আলোর সংকেত খুঁজেছিল?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.