পুস্তক পরিচয় ২...
ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার তাপে উপভোগ্য
আয়না ভাঙতে ভাঙতে: চিন্ময় গুহ-র সঙ্গে কথোপকথন। গাঙচিল, ২৫০.০০
ক ব্যতিক্রমী বই আয়না ভাঙতে ভাঙতে, যাতে ১৪ জনের বয়ানে ফুটে উঠেছে সময় আর স্বাতন্ত্র্যময় সংগ্রামের ছবি।প্রশ্ন করে তাঁদের অন্তরবার্তা যিনি বাইরে এনেছেন সেই চিন্ময় গুহ এখনকার এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। বেশ সময় নিয়ে এবং ব্যাপ্ত পরিসরে কথোপকথনের সূত্রে তিনি তুলে এনেছেন সমকালের সাংস্কৃতিক পট। পাঠকরা কৃতজ্ঞ থাকবেন এই জন্য যে, ২০০০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে দেশে বিদেশে নেওয়া এ সব কথা-কথনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, জ্যোতিভূষণ চাকী, বাদল সরকার, পুরুষোত্তম লাল ও শিশিরকুমার দাশ ইতিমধ্যে প্রয়াত। চোদ্দ জনের মধ্যে বারো জন বঙ্গসন্তান। ফাদার দ্যতিয়েন আর পি লাল, দু’জনাই গভীরার্থে বাঙালি জীবনে সম্পৃক্ত।
চোদ্দ জনের আত্মবিবৃতি ও জীবনভাষ্য ২৩৯ পৃষ্ঠায় ধরা আছে এবং মোটামুটি কালক্রম মেনে (দীপেন্দু চক্রবর্তী ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ক্রম গোলমাল হয়ে আছে, প্রথম জনের জন্মসাল ১৯৪৫, শেষ জনের ১৯৪২)। খুঁতখুঁতে স্বভাবের কেউ কেউ বলতে পারেন ওই চোদ্দ জন কেন? চিন্ময় গুহ খুব সংগত ভাবে কবুল করেছেন: ‘কথা বলতে চাই এমন কারুর কারুর সঙ্গে কথা বলা বাকি থেকে গেল। হয়তো ভবিষ্যতে সে সুযোগ আসবে।’ সেই অদূর ভবিষ্যের সম্ভাবনার কথা মনে রেখে আপাতত এখনই যা পেলাম, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। চিন্ময়ের ‘প্রাক-কথা’ পটে দু’টি নিবেদনের একটি হল: ‘আশাকরি এই সমবেত সংলাপ থেকে কিছু জরুরি চিন্তাসূত্র উঠে আসবে’ এ কথায় আমাদের সায় আছে, কিন্তু যখন তিনি বলেন, ‘বাংলায় এ ধরনের মুদ্রিত সংলাপের তেমন ঐতিহ্য নেই’ সে কথায় সায় নেই। তবে তাঁর এ কাজের উদ্দেশ্য বোঝানোর জন্য যখন বলেন, ‘শুধু মানুষটি ও তাঁর কাজকে বোঝার চেষ্টাই নয়, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি বয়ান খোঁজাও হয়তো ভেতরে ভেতরে আমার লক্ষ্য ছিল’, তখন সে অভিপ্রায়কে মান্য করতেই হয় এবং বলা চলে, সাক্ষাৎকারের কাজের মধ্যে আত্ম-প্রস্তুতির ছক এবং যাঁর সঙ্গে তাঁর কথার বিনিময় হয়েছে, তাঁর বিষয়ে প্রশ্নকারীর বিষয়গত অধিকার ও পাণ্ডিত্য আমাদের সম্ভ্রম আদায় করে। তাঁর এই প্রয়াসের গভীরে দুরূহের প্রতি দারুণ আকর্ষণ এবং অপ্রগল্ভ অথচ স্থিরলক্ষ্য এক ভাবনাবলয় চোখে পড়ে।
যিনি রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ও তপন রায়চৌধুরীর মতো প্রাচীনতম প্রাজ্ঞের কাছে সঠিক প্রশ্ন রাখেন, তিনিই আবার বাদল সরকার ও পুরুষোত্তম লালের মতো ক্রিয়াপর ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসে ভিন্নতর প্রাসঙ্গিক প্রশ্নমালা তৈরি করেন। যাঁদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন হয়েছে, তাঁদের সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল জীবন পরিচয় থাকায় পাঠকদের সুবিধা হয়। তবে, এ বই কোনও অর্থেই আম-পাঠকের ভোগ্য হবে না এর ঝোঁক এলিটিজিমের দিকে। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সঙ্গে পি লালের সঙ্গে বা অলোকরঞ্জনের সঙ্গে যে-সব গূঢ় প্রসঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে, তার মর্মভেদ করা অনেকের পক্ষে কঠিন হবে। সাক্ষাৎকারীর বিশেষ প্রবণতা হল অধ্যাপক শ্রেণিদের সঙ্গে কথা বলা। ভাল লাগে মৃণাল সেন আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র মতো চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে তাঁর সাবলীল আলাপচারী। কবিতা সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ আর নাট্য বিষয়ে বাদল সরকারের সঙ্গে চিন্ময় যে ভাবে কথা বলেছেন, তা পড়ে বেশ সম্ভ্রম জাগে। তাঁর প্রশ্নসূত্রে উঠে এসেছে ফাদার দ্যতিয়েন আর পি লালের বর্ণময় জীবনকথা, ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার তাপে ও বিচিত্রতায় যা উপভোগ্য।
এত ধরনের মেধাবী নারী পুরুষের (নারী ১ পুরুষ ১৩) কথাবার্তা থেকে আমরা নিষ্কাশন করতে পারি কতটা অস্মিতার বার্তা? রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বলেছেন: ‘সত্যিকারের বাঙালি মন, real Bengali mind, সেটা আমরা আজ হারিয়ে ফেলেছি’। তাঁর সিদ্ধান্ত: ‘বাঙালি কাউকে শ্রদ্ধা করে না... কোনও বিষয়ে seriousness নেই।’ তপন রায়চৌধুরীর মনে হয়েছে: ‘স্বাধীন ভারতে হাত-কচলানো সংস্কৃতি স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে।... আর তার সঙ্গে স্বজন তথা স্যাঙাৎ পোষণ’। শঙ্খ ঘোষের অবলোকনে অবশ্য সদ্যতন বাঙালির সংকট এটাই যে, ‘মৌলিক চিন্তায় আত্মনির্ভর গদ্যলেখা আমাদের পরিপার্শ্বে কমই পাওয়া যায়’। শিশিরকুমার দাশ সারা বিশ্বের শিক্ষাজগতে প্রার্থিত মান্যতা পেলেও স্বভূমি আর স্বভাষার চর্চায় পদে পদে বাধা পেয়ে লিখেছেন: ‘একজন লেখকের পক্ষে তাঁর ভাষা-জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা একটা বড় ক্ষতি। সেই ক্ষতি আমার হয়েছে।’ দীর্ঘ দিল্লিপ্রবাসে থেকে কুড়ি বছর অপেক্ষা করে শিশির অবশেষে বুঝতে পারলেন শিক্ষাজগতের অন্তর্ঘাতের স্বরূপ। অথচ আশ্চর্য যে, এর পাশে যাঁর বাবার ভাষা উর্দু, স্ত্রীর ভাষা বাংলা, মাতৃভাষা পাঞ্জাবি আর নিজের ভাষা ইংরেজি, সেই পুরুষোত্তম লাল সারা জীবন কলকাতায় বাস করে অনুভব করেছেন, ‘বাঙালির কল্পনাশক্তি, বাঙালির মন খুব creative। বাইরে যা-ই হোক, the Bengali psyche remains lyrical, creative, inquisitive, very sensitive... আর definitely concerned with the fine arts.’ অধ্যাপক দীপেন্দু চক্রবর্তী তাঁর জীবিকা থেকে অবসৃত হয়ে জানিয়েছেন, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছাত্ররা প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসুক। সে কাজ শুরুও করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ করলেন, ‘তারা পাশ করে অনেকেই সেই কেরিয়ারিজমের গণ্ডিতেই আটকে গেল।’
এ বইয়ের প্রথমেই যাঁর কথা, তাঁর জন্মসাল ১৯১৫ আর শেষ ব্যক্তির ১৯৫০। এই দীর্ঘ ভাঙা-গড়ার ইতিহাসবিন্দুতে স্বচ্ছ মুকুরের মতো স্পষ্টরেখ হয়ে আছে নানা ব্যক্তির সংকটের চিহ্ন। তবু এমন স্রোতোচ্ছল জীবনধারা আর মননজীবিতার স্পর্শে পাঠক অনেকটাই শিক্ষিত হবেন এবং তাকাবেন আত্মমুকুরের দিকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.