পুস্তক পরিচয় ১...
লাল দইয়ের খোঁজে দেবতা আসতেন
আপনাদের সেবায়/ স্বরসম্রাট আলি আকবর খান-এর আত্মজীবনী, গ্রন্থনা: অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। থীমা, ৩০০.০০
ময়ের কিছু সুগন্ধ থাকে। আমাদের যৌবনের রাসবিহারী মোড় এ রকম। আজ মনে হয় কী যে অলৌকিক দক্ষিণ কলকাতার এই স্বর্গোদ্যান: আমরা কত না দেখেছি সত্যজিৎ-ঋত্বিক বা বিষ্ণু দে-দের! এ রকমই সেই চত্বরে সামান্য লাল দইয়ের খোঁজে আরও এক জন দেবতা আসতেন মানুষের ছদ্মবেশে। তিনি আলি আকবর খান। সরোদশিল্পী বললে তাঁকে ছোট করা হয়। সরোদের তারে তিনি সৌন্দর্যের কারুবাসনা। ওই তারযন্ত্রে তিনি আঙুল ছোঁয়ালে মধুবাতা ঋতায়তে— সমুদ্রে ও নীলিমায় মধুক্ষরণ হত! নিজের ভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করি যে সামান্য মর্ত্যবাসী হওয়া সত্ত্বেও আমি স্বচক্ষে দেখেছি, একমেবাদ্বিতীয়ম্ বেহালাবাদক ইহুদি মেনুহিন যাঁকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরস্রষ্টা মনে করেন সেই ‘অ্যাবসলিউট জিনিয়াস’ আলি আকবর খান আমার সামনে হাতে টানা রিকশায় উঠছেন। যে দিন নিউ ইয়র্কে প্রথম ‘পথের পাঁচালী’ দেখানো হল, তার দু’দিন পরেই মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্ট-এ প্রথম বারের কনসার্ট আলি আকবরের। বাঙালি সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কত মায়াঞ্জন ছিল!
তাঁর আত্মজীবনী আপনাদের সেবায় পড়ে উঠলাম। নিজে তো লেখেননি, কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তা সম্ভব করেছে শিষ্য অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুলিখন। অনিন্দ্য গুরুবন্দনায় অবিচল থেকেছেন— নিজের উপস্থিতি জাহির করেননি। আলি আকবরের জীবনের অন্দরমহলে আমরা প্রবেশাধিকার পাই, কিন্তু যা আসল প্রাপ্তি তা হল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত ও আধুনিকতার সংলাপ। সেই সূত্রে এই বই আমাদের ইতিহাসের সহবাসে অভ্যস্ত করায়।
আমারে তুমি অশেষ করেছো এমনি লীলা তব— বলা ছাড়া আলি আকবর কী-ই বা অতিরিক্ত বলতে পারতেন জনক আলাউদ্দিন খানকে, বা হয়তো ঈশ্বরকেও! চলচ্চিত্রকার বার্গমান একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, মধ্যযুগের পর থেকে, শিল্প যখন অর্চনার থেকে পৃথক হয়ে গেল, ‘স্বাক্ষরিত’ হতে শুরু করল, অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তার ছাপ পেল, তখনই তার সংকটের সূত্রপাত। মহত্তম পর্যায়ের শিল্প, পার্থেনন বা পিরামিড বা অজন্তার গুহাচিত্র স্রষ্টার নাম বহন করে না। আলি আকবর ভেবেছেন তিনি তো মাধ্যম মাত্র; আত্মার সকল প্রদীপ জ্বেলে তাঁকে সুর ও লয়, রাগমালা নিবেদনে প্রস্তুত থাকতে হবে। নিদারুণ যন্ত্রণায় মথিত হতে হতে পশ্চিমের ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ যেমন করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন: হে ঈশ্বর! আমার আনন্দ যেন আমাকে না ছেড়ে যায়।’ পুবের আলি আকবর তেমন ভাবেই নিজের প্রতি নজর রাখেন: ‘আমি যখন বাজাতে বসি তখন আমি নিজে কতটা বাজাই জানি না, কারণ দু’-তিন মিনিট বাজাবার পর আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, আর আমি নিজেই শ্রোতা হয়ে নিজের বাজনা শুনতে থাকি।’
এই প্রবণতাকে আধুনিক শিল্পচৈতন্যের দায় থেকে সেলফ রিফ্লেকসিভিটি বলাই যায়। তবে আমার মনে হয়, আলি আকবর মাণ্ডুক্যোপনিষদ কথিত সেই সুপর্ণদ্বয়ের একটি যে ভোক্তা নয় সাক্ষী, যে চঞ্চল নয়— স্তব্ধ। সারা জীবন বাদ্যযন্ত্র হাতে আলি আকবর ভাস্কর্যের মতো স্থির, তপোক্লিষ্ট, সন্ধান করে গিয়েছেন ব্যাকুল তন্ত্রীর আড়ালে যার আনন্দ ঝরে পড়ছে তার: সেই অন্তরতমের।
এমনকী চলচ্চিত্রেও তো খেয়াল করে দেখেছি, ‘অযান্ত্রিক’ ছবির বিমল আকাশের দিকে তাকালে আলি আকবর কী ভাবে শরতের শাদা, হালকা খুশির মেঘ হয়ে উঠতে পারেন। তাঁরই রচিত আবহ সংগীতের সৌজন্যে। ‘দেবী’ বা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে তাঁর টুকরো টুকরো কাজ যে জড়োয়া গয়নায় পাথর সেটিং-এর মতো জুড়ে গিয়েছে, তার কারণ সুরস্রষ্টা আলি আকবর নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন না; তিনি বিমূর্ততার সাধক নন, বরং সাকার প্রতিমা তাঁর আরাধ্য। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ভাবে দাবি করেন— ‘আমাদের সংগীত প্রধানত গানের ওপর ভিত্তি করে, কারণ আমি যখন বাজাই, আমি আসলে তখন মনে মনে গান করছি... গান না জেনে ভারতীয় যন্ত্রসংগীত বাজানো অনেকটা খাবার ছাড়া শুধু চামচ মুখে দেবার মতন।’ নিরাবেগ বৈয়াকরণিক নন বলেই গাছপালার মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দর্শকমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে একটু করুণ রস সঞ্চারের জন্য মধুবন্তী রাগের অবরোহণে কোমল ‘নি’ আর শুদ্ধ মধ্যম যুক্ত করে তাতে ভীমপলশ্রীর শ্যামলিমা জুড়ে দেন। অন্যত্র রেকর্ড শুনে উচ্ছ্বসিত শ্রোতাদের দাবিতে তিনি চার ঘণ্টা ভৈরবী বাজিয়ে যান, কিন্তু বৈচিত্র সঞ্চারের জন্য অনায়াসে তাতে বাহার রাগ মিশিয়ে নেন। কী আলগা, আলতো স্বরে, যেন ব্যাপারটা তো কিছুই না। এ ভাবে আলি আকবর মিরাকল ঘটান— ‘আমি শুদ্ধ ভৈরবী বাজাচ্ছিলাম, বাজাবার মাঝে হল কী আমার আঙুলটা শুদ্ধ ধা স্বরে আটকে গেল, আর আমি ওটাকেই সা ধরে বাকি রাগটা বাজালাম।’
এই মুহূর্ত চন্দ্রশেখরের জটাজাল থেকে জাহ্নবীকে মুক্ত করার মুহূর্ত। প্রতি পলে নিজেকে অনিঃশেষ ভাবে পাল্টে নিতে পারেন বলেই আলি আকবর মুক্তধারা। তিনি যে ভাবে আমাদের তীব্র কোমল বারোটা স্বরের মধ্যে এগারোটা নিয়ে গৌরীমঞ্জরী রাগ নির্মাণ করেন বা রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে বাগেশ্রীতে আধারিত একটি রাগে পঞ্চম স্বরে বক্রতা মিশিয়ে জন্ম দেন সাংগীতিক ‘নন্দিনী’-র, ভাষাপথ স্ব-বলে ও স্ব-প্রতিভায় খনন করার দুঃসাহস দেখান, তাতে সুন্দরের গমন ও বিস্তার স্বাভাবিক হয়ে আসে। অজানা প্রদেশে ভ্রমণের এই সাধনা যে কী অলৌকিক ভাবে এই সুর-তপস্বীকে অধিকার করেছিল, তা জেনে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদে— ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পল্লী নিসর্গের অদূরেই জেগে থাকে আদিগন্ত সুরের ভুবন; বাবা আলাউদ্দিন তাঁকে সুদীর্ঘ রেওয়াজের মানচিত্র উপহার দেন। সেই অক্ষ ও দ্রাঘিমারেখা সম্বল করে বিদ্যুল্লতার মতো তাঁর আঙুল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রতিটি রক্তবিন্দুতে উপলব্ধি করায় যে ভূপালী আর শুদ্ধ কল্যাণের মধ্যে তফাত হল শুদ্ধ কল্যাণের আরোহী ভূপালীর মতন আর অবরোহী ইমনের মতন। আর এই অভিজ্ঞতার বীজ বুনে দেওয়া জরুরি। যা ছিল ঘরানায়, যা ছিল গুরুকুলে, সেই সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আলি আকবর নিয়ে আসতে চান সুনিয়ন্ত্রিত পাঠ্যক্রমের আধুনিক প্রশিক্ষণে। গ্রেগরিয়ান চান্টের সঙ্গে ধ্রুপদের মিল যে ভাবে চারটি ভাগ দেখিয়ে তিনি বোঝান, তাতে সংগীতের আঞ্চলিক দেওয়াল ভেঙে পড়ে, তুলনামূলকতার বারান্দা দিয়ে নিখিলের আনন্দের দিকে চোখ মেলে দেওয়া যায়।
এই বইয়ের পাতায় পাতায় বেজে যায় আলি আকবরের সারল্য আর অননুকরণীয় বিনয়! তুলনারহিত পিতৃভক্তি তো কৃত্তিবাসী রামায়ণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুরেলা। আলি আকবর জানেন না এত সাধনা, এত কামনা কোথায় মেলে, তবু তাঁকে জেগে থাকতে হয় আঠারো থেকে কুড়ি ঘণ্টার রেওয়াজে আর অনুশীলনে। তিনি শুধু জানেন একদিন তাঁর রাত্রি এসে মিলবে দিনের পারাবারে। অর্ঘ্য নিবেদন, সেবা হয়তো পূর্ণতায় পৌঁছে যাবে। ‘যে দিন আসল সা-টা লেগে যাবে, সে দিন আমি আর থাকব না।’ কী সংহত তাঁর উচ্চারণ! আর তার আগে তো ‘লাস্ট সাপার’; শিষ্যদের দিয়ে যান ধ্যানমন্ত্র: স্বর ও শ্রুতি অনেকটা প্রেমিক-প্রেমিকার মতন... তাকে ব্যবহার করতে গেলে স্পর্শ করতে হবে ঠিক মা যেমন তাঁর শিশুকে আদর করেন, সেই ভাবে।’
অনিন্দ্য কী যে উপকার করলেন— তাঁকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। তাঁর গ্রন্থনা আমাদের জানিয়ে গেল ‘ঈশ্বর’ সুর সাজাতেন এই কলকাতাতেই!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.