নাটক সমালোচনা...
উঠে বসি, ঈর্ষা হয়
বার‌্টোল্ট ব্রেখ্ট বলেছিলেন, “আমি নির্ভেজাল ঘটনা দেখাই যাতে দর্শক নিজের মতো করে ভাবতে পারে। নিজের মতো ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ থাকে। আমার নাটকের মানে নাটকেই অন্তর্নিহিত। সেটা খুঁজতে হবে... আজকাল নাটকের মানে ঝাপসা হয়ে যায় কারণ অভিনেতারা সারাক্ষণ দর্শকের হৃদয় কাড়ার জন্য অভিনয় করে।”
স্বপ্নসন্ধানীর সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘ম্যাকবেথ’ দেখতে দেখতে আমার ব্রেখ্ট-এর এই কথাগুলো বার বার মনে পড়ছিল। কৌশিক সেনের সার্থকতা এবং বিপর্যয় দু’টোরই কারণ ব্রেখ্ট-এর এই উদ্ধৃতি। উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের অত্যন্ত বালখিল্য অনুবাদ সত্ত্বেও, কৌশিকের ‘ম্যাকবেথ’ একটা জমজমাট প্রযোজনা হয়ে ওঠে স্রেফ কৌশিকের শেক্সপিয়রের কাঠামোর প্রতি একবগ্গা আনুগত্যের জন্য। কিন্তু অভিনয় বড়ই বেশি হৃদয় কাড়ার জন্য। মাঝে মাঝেই ঘটনা ঝাপসা হয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় আশার কথা যে বহু দিন পর কৌশিক আবার প্রমাণ করলেন যে বাংলা থিয়েটারে শর্টকাট না নিয়ে, জোর করে রূপান্তর না করেও কালজয়ী ক্ল্যাসিক করা সম্ভব। যদিও অপটু ভাষান্তরের জন্য সব ভাল, ভাল স্বগতোক্তিগুলোই মাঠে মারা যায়, তবুও কৌশিকের ম্যাকবেথের যন্ত্রণা এবং দ্বিচারিতা প্রকট ভাবে বেরিয়ে আসে। এই লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শেষকালের সর্বগ্রাসী ধ্বংসের গল্পটির অন্তর্নিহিত আদিম সত্যটা জ্যান্ত হয়ে ওঠে। শেষের বাড়তি এপিলগটাতে আমার প্রবল আপত্তি। হয়ত নির্দেশক সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চেহারাটা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারেননি। কিন্তু কৌশিকের নাট্যচেতনার কাছে আমার আব্দার, ‘শেক্সপিয়রের ওপর বিশ্বাস রাখুন। ওখানে সব আছে। এখনও সমকালীন।’
যে নির্দেশক ম্যাকবেথের শেষ লড়াই এবং মৃত্যুকে হারাকিরির মতো করে দেখাবার সাহস এবং অন্তর্দৃষ্টি রাখেন, তাঁকে আমার অনুরোধ শেষ এপিলগটা এক্ষুনি বাদ দিন। ডোনাল্ড বেনের শাষণটা যে গোলমেলে তা বেরিয়ে আসবেই।
‘ম্যাকবেথ’ নাটকে কৌশিক ও রেশমী সেন
মঞ্চ পরিকল্পক সৌমিক আর পিয়ালি দু’টি বেসিক রং বেছে নিয়েছেন। লাল আর কালো। নাটকের অন্তর্নিহিত হিংসা প্রকট হয়ে ওঠে। রেশমী সেনের মিলিটারি পোশাকের ব্যবহার সেই মেজাজটাকে আরও উস্কে দেয়। তথাকথিত মুড-লাইটিং-এর বদলে আরও বেশি অন্ধকার আশা করেছিলাম। কিন্তু লেডি ম্যাকডাফ আর তাঁর শিশুদের হত্যার দৃশ্যের আলো জয় সেনের সব গোলমাল ভুলিয়ে দেয়। শুধুমাত্র একটি ফুটলাইটের আলোতে ম্যাকডাফের শিশুর দোলনার ছায়া যখন ভয়ার্ত রস-এর মুখে পড়ে আমি একটা অত্যন্ত বড় মাপের থিয়েটারের মুহূর্তে ডুবে যাই। আমার ভীষণ প্রিয় হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনা ‘ডুরান্ড মার্ট’-এর তিন বিজ্ঞানীর খুনের দৃশ্যটা মনে পড়ে। আমার ভেতরে থিয়েটার বেঁচে ওঠে।
রেশমী সেন তাঁর রূপের পেছনে একটা ঠান্ডা হৃদয় লুকিয়ে রাখেন। তাঁর লেডি ম্যাকবেথের অভিনয় এই নাটকের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তিন ডাইনি রেশমীর ঠান্ডা আগুনের কাছে বড়ই বেমানান। একমাত্র ঋদ্ধি সেনের তৃতীয় ডাইনি হাজার নৃত্যকলা ছাপিয়ে মাঝেমধ্যেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠে নাটকের হিংস্রতার কথা মনে করায়, কারণ তার উচ্চারণ পরিষ্কার। সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠান্ডা ব্যাঙ্কো অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।
কৌশিক সেন আমার কাছে নিঃসন্দেহে এখনকার একজন অত্যন্ত বড় অভিনেতা। কিন্তু তাঁর প্রথম পর্যায়ের ম্যাকবেথ বড় বেশি বিভ্রান্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের অনিশ্চিত অভিনয় প্রথম অর্ধের ভুলভ্রান্তিকে খানিকটা ভুলিয়ে দেয়। হতাশ চোখে সিংহাসনে বসে কৌশিক যখন তুড়ি মেরে ভাড়াটে খুনিদের ভাগিয়ে দেন, আমি একটা নিদারুণ অসহায় রাজাকে খুঁজে পাই। ইন্টারভ্যালের পর ম্যাকবেথ সত্যি হয়ে ওঠে।
ব্যাঙ্কোর ভূতের দৃশ্য (এখানে কৌশিক ব্যাঙ্কোকে নৈশভোজের অতিথিদের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন) অনেক সম্ভাবনা নিয়ে বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তুলনামূলক ভাবে পোর্টার দৃশ্য এবং বারনাম জঙ্গল চলার দৃশ্য— দু’টোই বড় ছাপোষা।
কিন্তু ম্যাকবেথ তার ডাইনিদের সঙ্গে দ্বিতীয়বার মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্য এই নাটকের সবচেয়ে বড় পাওনা। গোটা দৃশ্যে ম্যাকবেথ আর তিন ডাইনি একটা দড়িতে বাঁধা থাকে। যতই ওরা পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পরে আমার গুলিয়ে যায় কে কাকে চালিত করছে। ডাইনিরা ম্যাকবেথকে নাকি ম্যাকবেথ ডাইনিদের? এই মুহূর্তটি নিঃসন্দেহে আমার কাছে বাংলা থিয়েটারের অনেক কটা শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের একটা হয়ে থাকবে। যেমন ‘চাক ভাঙা মধু’তে মায়া ঘোষের পেটের বাচ্চা হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যায়। যেমন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রেয়ন তার আংটি ঠুকে আন্তিগোনেকে চুপ করায়। যেমন বাদল সরকারের আজদাক বড়ই অবহেলা করে মাটিতে খড়ির গণ্ডি কাটে। পিটার ব্রুক বলেছেন বড় থিয়েটার আসলে কিছু মুহূর্ত যা গোটা নাটকের মূল সত্য তুলে ধরে। এই ডাইনি আর ম্যাকবেথের শরীর জড়িয়ে পরার মুহূর্ত ম্যাকবেথের মূল সত্যটা হঠাৎ বলে দেয়। আমি, একজন হতাশ থিয়েটারকর্মী, উঠে বসি। আমার ঈর্ষা হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.