তিন দশক আগে এই পথটা পেরোতে সময় লেগে গিয়েছিল চারটে বছর। তিন দশক পরে ওই দূরত্ব পেরোতে তিন মাসও লাগল না।
মেট্রো রেলের খোঁড়াখুঁড়ির সৌজন্যে সে বার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দুর্ভোগ পুইয়েছিল শহরবাসী। এ বার সুড়ঙ্গের প্রথম এক কিলোমিটারের কাজ শেষ হতে চললেও শহরের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ কার্যত অটুট।
দু’টি অধ্যায়েরই সাক্ষী মধ্য পঞ্চাশের এক অনুচ্চ চেহারার বঙ্গসন্তান। শুক্রবার দুপুরে কলকাতার পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো রেলের সদ্য খোঁড়া সুড়ঙ্গে আনন্দবাজারের সফরে তাঁকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া গেল।
প্রথম বার সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল বেলগাছিয়ায় খালের নীচ দিয়ে শ্যামবাজারে পৌঁছনো। এ বার সুড়ঙ্গ নির্মাণের প্রথম পর্বে বেলেঘাটা সুভাষ সরোবর থেকে ফুলবাগান অবধি পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে। সুড়ঙ্গের এই অংশটির কাজ যারা করেছে, অনিরুদ্ধ রায় সেই সংস্থার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। তিন দশক আগে কলকাতার প্রথম মেট্রো নির্মাণের সময়ে তিনি ছিলেন সংশ্লিষ্ট নির্মাণ সংস্থার তরুণ ইঞ্জিনিয়ার।
সল্টলেকের দিক থেকে সুভাষ সরোবরের কাছে ‘পাতাল-প্রবেশ’-এর পরে গোলাকার সুড়ঙ্গ ধরে এগোবে পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো। সুভাষ সরোবরের কাছ থেকেই মাথায় হেলমেট পরে সুড়ঙ্গের সিঁড়ি ধরে নীচে নামা গেল। তার পরে ট্রলিতে সুড়ঙ্গ-সফর। |
আশির দশকে কলকাতায় প্রথম মেট্রো রেলের সঙ্গে এই নব্য মেট্রোর অনেক ফারাক। সুড়ঙ্গে ট্রলি ট্র্যাক ধরে চিলতে গাড়িতে যেতে যেতে অনিরুদ্ধবাবু বলছিলেন, “এখন চাইলে দিনে ১৫ মিটার সুড়ঙ্গও খোঁড়া সম্ভব। কিন্তু সে বার মাটি খোঁড়া, ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে এর তিন গুণ লোক লেগেছিল।” এখন শিফ্ট পিছু ২০-২৫ জন লোকেই কাজ সারা হচ্ছে। সদ্য-কাটা মাটির স্তূপ কনভেয়ার বেল্টে চেপে বাইরে বেরোচ্ছে। ফেলার পরে ছোঁ মেরে মাটি তুলে সাফ করছে অতিকায় গোলিয়াথ ক্রেন। ডানকুনির শিল্পাঞ্চলে নির্দিষ্ট এলাকায় ফেলা হচ্ছে ওই বর্জ্য।
সুড়ঙ্গের এই অংশটি গড়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাইল্যান্ডের একটি সংস্থার (আইটিডি) প্রজেক্ট ম্যানেজার (টানেল) চান্ডি মুখান বলছিলেন, “ফুলবাগান-নারকেলডাঙা এলাকায় সুড়ঙ্গের উপরে বহুতলগুলিতে এক ধরনের ‘সেন্সর’ বসিয়ে সাবধানে কাজ সারতে হয়েছে। যাতে বাড়িগুলোর ভিত নড়ে না যায়।” অনিরুদ্ধবাবুর মনে আছে, গিরিশ পার্ক-জোড়াসাঁকো অঞ্চলে আশির দশকে মেট্রোর কাজের জেরে বেশ কিছু পুরনো বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
যজ্ঞের মূল ‘হোতা’র সঙ্গে দেখা হল সুড়ঙ্গের কিনারে পৌঁছে। দোতলা বাড়ির সমান উঁচু ৮০ মিটার জায়গা জুড়ে ছ’মিটার ব্যাসের জার্মান যন্ত্রের নাম টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম)। সুভাষ সরোবর থেকে ফুলবাগানের মধ্যে ৭৫০ মিটার লম্বা দু’টি সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে এই যন্ত্রই। একটি সুড়ঙ্গের কাজ শেষ। আর একটি সামান্য বাকি। সংস্থার এমডি সুব্রত গুপ্ত জানালেন, পূর্ব ভারতে এই প্রথম টিবিএম দিয়ে কাজ হচ্ছে। টিবিএম-এরই প্রকাণ্ডতর সংস্করণ এর আগে কানাডার নায়াগ্রা টানেল বা সেন্ট পিটার্সবার্গের অরলভ্স্কি টানেল গড়ে তুলেছে। ইঞ্জিনিয়ারেরা বোঝালেন, ১.৮ মিটার মাটি সরিয়ে বিরাট-বিরাট কংক্রিটের চাকতি বসিয়ে গোলাকার সুড়ঙ্গ গড়া হচ্ছে। মাটি থেকে ১১ মিটার গভীরে দাঁড়িয়েও নিঃশ্বাস নেওয়ার কষ্ট নেই। সুড়ঙ্গের উপরে একটি হলুদ পাইপ। তার মাধ্যমে তাজা বাতাস সরবরাহ চলছে।
শেষ ধাপে লন্ডনের টেম্স টানেলের আদলে গঙ্গার তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ পৌঁছবে হাওড়া ময়দান অবধি। তবে ‘রুট’ নিয়ে এখনও জটিলতা কাটেনি। কয়েকটি দোকান সরানো নিয়ে সমস্যা আছে। তাই শিয়ালদহ থেকে সেন্ট্রাল হয়ে সুড়ঙ্গ মহাকরণে যাবে, নাকি অন্য রাস্তা ধরবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। |