রবিবাসরীয় গল্প
মিরুজিন
মার ছোটকাকু। ছোটকা। ধ্রুব বসু। আমার রোল মডেল। আরে না, না, সে রকম কিছু নয়। একেবারে সাদামাটা লোকটা। একেবারে সাধারণ। আকর্ষণীয় বলতে, না, তেমন কিছু নয়। এলেবেলে লেখালিখি করে। আক্ষেপ নেই। ছোটাছুটি নেই। তবে ভাবুক।
বাবাকে বলেছি, বাবা, ছোটকা আর আসে না কেন আমাদের বাড়ি?
বাবা বিরক্ত হয়। বিষণ্ণ হয়। অস্বস্তি বোধ করে। বলে, ছেলেটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল কেমন। কোনও একটা লাইনে গেল না।
আমি জানি, ছোটকা গ্রামের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে। মেজকা-কাকিমার কাছে থাকে। আবার চলেও যায়। কলকাতায় কোনও মেসে থাকে। জানি না, কী কাজটাজ করে। এগজ্যাক্ট ঠিকানা কেউ জানি না। আগের ফোন নম্বর অকেজো।
আগে যে কত আসত? বাবাকে বলি।
বাবা নির্বিকার থাকে। আসলে আমি জানি, বাবার যাবতীয় সমৃদ্ধি কী ভাবে। অম্বুজা কলোনিতে এত বড় বাড়ি। গাড়ি। মায়ের সব চাহিদাই বাবা পূরণ করে যায়। আমারও।
ইদানীং, ও সব কাঁটা মনে হচ্ছে আমার। ছোটকার কী মনে হত! ছোটকা কি কোনও দিন প্রশ্ন করেছিল বাবাকে, কী করে এ সব হচ্ছে?
এক দিন দুপুরে ছাদে খুব বকাবকি চেঁচামেচি হয়েছিল। মূলত বাবাই কী সব বলে যাচ্ছিল। ছোটকা চুপ করে সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছিল। আমি কাছে যেতেই বাবা নীচে নেমে গিয়েছিল। ছোটকা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, তোর চুল খুব সুন্দর। হাওয়ায় ওড়াবি। মাঝে মাঝে বাঁধন খুলে দিবি। ছোটকা আমার চেয়ে বছর পনেরোর বড়। বাবার থেকে অনেক ছোট।

দুই
এখন আমার তেইশ-চব্বিশ। ছোটকা আর মা প্রায় সমান সমান। মায়ের সঙ্গে বাবার বয়সের বেশ ফারাক।
বাবা সোসাইটির ক্লাবে যায়। বেশ রাত্তিরে বাড়ি ফেরে। মা-ও যায়। ক্লাবে নয়। বন্ধুবান্ধবের বাড়ি। আর যায় বাজার। প্রচুর জিনিস কিনতে ভালবাসে মা। এ ব্যাপারে মায়ের একটা পাগলামি আছে। অবশ্য মা বলে, পাগলা মার্কেট। মার্কেটটাই পাগলা।
মাঝে মাঝে আমিও যাই। মা-র সঙ্গে। বাজারের মধ্যে কেমন সেঁদিয়ে যাই আমরা। কী যে নেই বিগ বাজারে! অনেক কিছু কিনেটিনে আমরা বাড়ি ফিরি রিকশায়। বাবা থাকলে গাড়িতে। মা বেশ তাজাই থাকে। বাড়িতে এসে মা ফ্রেশ হয়ে নেয়। একপ্রস্থ মেক-আপ চড়ায়।
আর আমার ভয়ঙ্কর পাগল-পাগল ভাবটা তখনও থেকে যায়। এ ঘর থেকে ও ঘরে যাই। অস্থিরতা টের পায় না মা, বাবা। রুম অন্ধকার করে বসে থাকি। ছোটকাকে মনে পড়ে তখন। একটু অস্থিরতা কমে। একটু শান্তি পাই। চোখ বুজে দেখতে পাই লম্বা একটা মানুষ কাঁধে ব্যাগ, চোখে হাল্কা চশমা, গালে অল্প দাড়ি, হেঁটে যাচ্ছে লম্বা লম্বা পা ফেলে। ছোটকার লক্ষ্য কী, উদ্দেশ্য কী, কেউ জানে না।
বাবাও জানে না। তবু বাবা বলে, জীবনে ছোটার যে মানসিকতা তা ধ্রুবর নেই। পৃথিবীতে কুঁড়ে লোকেরাই কবিতা লেখে।

তিন
আজও আমার ভাল লাগছিল না। বাবা বলছিল, তুই একটা মেয়ে। দিন কে দিন কেমন যেন মরোজ হয়ে যাচ্ছিস। জাস্ট এনজয় ইওরসেল্ফ। দ্য ভিগরাস ওয়ার্ল্ড ইজ লেফ্ট বিফোর ইউ।
আসলে বাবা এ সব কথা বলছিল, কারণ বিয়ের প্রস্তাবে আমি আগ্রহ দেখাচ্ছি না। ছেলের বর্ণনা বাবা দিয়েছে। চেহারা-চাকরি-বিত্ত সবই এ ক্লাস।
আমার কি অসুখ হল কোনও? আমি আগ্রহ পাচ্ছি না কেন? কাম-আকাঙ্ক্ষা সবই তো আমার আছে। আমার মন কি তবে অন্য কিছুতে নিবেদিত? আমি বাইরের দুরবস্থা, জটিল সময়টা নিয়ে ভাবি। ছোটকা, ছোটকা, ছোটকা...। কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে ভেতরটা, দিশেহারা লাগে। ছোটকা একটা উদ্ভাস আমার কাছে।
বাবা বলে, ও-সব নেগেটিভ দিক। ও-সব ভাবলে জীবনে উন্নতি করা যায় না। বড় হওয়া যায় না।
আমি বাবার সিগারেটের ধোঁয়া জানলা দিয়ে পার হতে দেখি। আমার বন্ধু গার্গীর কথা মনে পড়ে। কী চপল ছিল মেয়েটা। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় এক অধ্যাপকের ছেলেকে বিয়ে করে এখন বিদেশে। গার্গীর অ্যাম্বিশন ছিল। ওখানেও হয়তো ও নিশ্চয় কিছু করছে।
গার্গী আমাকে বলত, তুই একটা মেদামারা মেয়ে। ইউ শ্যাল নেভার ফ্লারিশ...।
অন্ধকারে বসে আমার কান্না পেতে লাগল। ছোটকা বলেছিল মনখারাপ হলে জীবনানন্দ পড়বি। ক’টা লাইন ঝটিতে চলে এল মনে। আর অন্ধকারে ছোটকার কণ্ঠস্বর কোথা থেকে যেন ভেসে এসে বেজে যেতে লাগল—
পৃথিবী প্রবীণ আরও হয়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে;
বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে। এ প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই, সোনালি আগুন চুপে, জলের শরীরে
নড়িতেছে— জ্বলিতেছে— মায়াবতীর মতো জাদুবলে।
মিরুজিন নদীটা কোথায়? প্রাসাদ বিবর্ণ কেন? কেউ নেই বলে? সোনালি আগুন জলের শরীরে? পরের লাইনটা আরও অদ্ভুত— ‘সে আগুন জ্বলে যায়— দহে নাকো কিছু।’
কবিতার লাইনগুলোকে আপাত ঘুম পাড়িয়ে রাখি। অনুসন্ধান, ওগুলোকে বোঝার, ভেতরে ভেতরে জাগিয়ে দিই। কত কী মনে হয় তখন। অথচ কাউকে যেন বলা যায় না। ব্যাখ্যা করা যাবে না। কী একটা আগুন। হয়তো দহনও করে। কিন্তু পুড়িয়ে ছাই করে দেয় না।
ছোটকা বলেছিল, কবিতাটার মধ্যে অনেক অনেক সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি যেখানে শেষ মনে হবে, পৌঁছলে দেখবি, সেখান থেকে আরও আরও সিঁড়ি নেমে গিয়েছে।
কী আশ্চর্য! আমি দেখতে পাচ্ছি মৃত সারস। দু’চারটে নক্ষত্র। গার্গী, বাবা-মা। মাল্টিপ্লেক্স। বিজ্ঞাপন। নয়েজ নয়েজ নয়েজ...। ওহ কান ঝালাপালা হয়ে গেল। ওই তো ওপরে দাঁড়িয়ে ধ্রুব বসু। পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াচ্ছে। অদ্ভুত আবেশে ভরা সিঁড়িগুলো টপকাতে টপকাতে আমি ছুটে যাচ্ছি ধ্রুব বসুর দিকে। ধ্রুব বসু চল্লিশের ইয়ংম্যান। ধ্রুব বসু এক জন সাধারণ কবি। ধ্রুব বসু একটা অস্পষ্ট মানুষ।

চার
এখন মগ্ন শীত। দুপুরে ছাদে বসেছিলাম। চুল খুলে মাথা শুকোচ্ছিলাম। হাওয়ায় ওড়াচ্ছিলাম, মনে মনে এক জনের কথা ভেবে চুল ওড়ানোর আনন্দ পাচ্ছিলাম। দুরন্ত রোদ আর ভাল শীত। আর দুরন্ত আমার চুল। মা বলে, আমি তার মতো সুন্দরী নই। কিন্তু আমার চুল আশ্চর্য ঝরনা। আমি তো ওড়াচ্ছি। গড়িয়ে দিচ্ছি আকাশে। তার রিমঝিম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শব্দ, ঠিক ভাবে শুনলে, গানও হয়ে যায়। আমি তা হলে ঠিকই শুনছি। ওই তো আমার চুলগুলোকে স্ট্রিং ভেবে এক উদাস নিসর্গ বীণায় কেমন গান তুলেছে। সেই সুর, গান অখিল আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মা কখন ছাদে এসেছিল কে জানে। শুধু নেমে যাওয়ার সময় আমার আচ্ছন্নতা ভেঙে দিয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ রে, কিছু ভাবলি? দু’দিন তো হয়ে গেল।
সম্ভবত আমার হাতে ধরা চিঠিটা দেখেই মা-র ও রকম বলতে ইচ্ছে হল। চিঠিটা স্টেট ব্যাঙ্কের পি ও পদে রিট্ন পরীক্ষায় সফল হওয়ার চিঠি। এ বার ইন্টারভিউ। কলকাতায়। এক মাস পর।
এখন না ভাবলেও হবে ও-সব ব্যাপার। ঢের দেরি আছে। কিন্তু মুহূর্তেই আমার মনে হল, মা কি অন্য কিছু ব্যাপারে আমাকে ভাবতে বলে গেল। এ ক্লাস বর, এ ক্লাস ঘর, এ ক্লাস চাকরি। ইঞ্জিনিয়ার। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালে আছে বর্তমানে। রোদের মতো ঝলমলিয়ে উঠল সব কিছু। আমার চোখেমুখে নিশ্চয় আনন্দ ফুটে উঠল। গার্গীর মুখটা হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল। গার্গী এখন স্টেটস-এ আছে। কী দারুণ বৈভবে আছে। আমিও হয়তো ও রকম পেতে পারি। পেতে চাওয়ার ইচ্ছের মধ্যে যত রোমাঞ্চ আছে, অপরাধবোধও কম নেই। আমি তা হলে শেষমেশ কী করতে চাই, আমি তা জানি না। মনে হয়, চাকরি নিয়ে নিজের মতো জীবন কাটাব। ছোটকা বলেছিল, একেবারে গ্রামের স্কুলে পড়ানোর চাকরির কথা। বাবাকে ও-কথা বলাতে খেপে উঠেছিল। বলেছিল, তোর মাথাটা গেছে। পৃথিবীটাকে দেখ, হাউ গ্লোরিয়াসলি চেঞ্জিং...।
পৃথিবী বলতে এই শহরের এই কলোনির ঝলমলে রঙিন ব্যাপারস্যাপার! এই বাইরে আরও অনেক কিছু? আমার মতো ঘর আর কলেজ-পাশ মেয়ের কাছে সে পৃথিবীর খোঁজ দিয়েছে ছোটকা। আমি যেন কী ভাবে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাই। ছোটকার গ্রাম। ভেঙেচুরে যাওয়া তথাকথিত জীবনযাপন। ভিড়হীন নিসর্গ। ছোটকা এক বার বলেছিল, কলকাতায় থাকতে থাকতে ব্যথাগুলো সবুজ হয়ে যখন টনটন করে, তখন গ্রামে যাই। সেখানকার যন্ত্রণাগুলো মিলেমিশে কলমে চলে আসে।
আমার যে কলম নেই। আমার যে কবিতা নেই।
নেই... নেই... নেই...। কথাটার প্রতিধ্বনি হতে লাগল সারা ছাদে। আর সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন আমাকে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করতে লাগল, তোর কি এ সব আদৌ দরকার? প্রকৃতই কি ও-সব চাস তুই? আমার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব শুরু হল।
আর আমি অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগলাম তখন সারা ছাদময়। আমার চুলগুলো হাওয়ার কবলে পড়ে ছটফট করছে। কে যেন ভেতর থেকে বলছে, এই বেশ ভাল আছি, এই বেশ ভাল আছি।
আমিও দিশেহারা হয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, ভাল আছি, ভাল আছি, ভাল আছি...।
মাথার মধ্যে জটিল হতে থাকা সূত্রগুলো আপাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। চেয়ারে রাখা সেলফোনটা বাজছে। রিং টোনে সুন্দর একটা গান। গানটা বাজলে মনে হয় বহু দূর থেকে বাজছে।
কে?
আমি চয়ন। তোর সঙ্গে এক বার দেখা করতে চাই।
কেন?
বাড়িতে যেতে পারি?
কখন?
আজ। বিকেলে। প্লিজ, না বলিস না...।
কিন্তু কেন... হ্যা...লো।

পাঁচ
আমার ঘুম আসছে না কিছুতেই। মাথায় কেমন একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কত কী এসে ভিড় জমাচ্ছে। মন আর ভাবতে পারছে না। মন আর নিতে পারছে না। কিছুটা এ ঘরের মতো। এ ঘরটা দিন-কে-দিন দামি পণ্যে ভরে উঠেছে। আজও বাবা কিছু একটা কিনেছে মল থেকে। বস্তুটা কী যেন...। না, মনে পড়ছে না। আমার কি মাথার কোনও অসুখ হল!
নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ঘুমটা কী? কী ভাবে ঘুমোতে হয়? ঘুম কী ভাবে আসে? চোখ বুজে চয়নকে দেখতে পেলাম। আমার সঙ্গে ওর কী দরকার। ছেলেটা ভাল। কিন্তু বড় ভ্যাবলা। কলাবাগান বস্তির কাছাকাছি কোথাও বাড়ি। আসানসোলে একসঙ্গে ব্যাঙ্কের পি-ও পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। ও কি পেয়েছে ইন্টারভিউ লেটার? ও যেন পায়। যেন পায়।
কী করে ঘুমোতে হয়। কী করে ঘুম আসে! চোখই কেবল বুজে আছি। ঘোর লাগছে। বেশ একটা ঘোর।
বাথরুমে জামাকাপড় কাচছে ছোটকা। আমি বলছি, রেখে দিতে পারতে, কাল কমলিদি কেচে দিত। ছোটকা বলছে, ধুর বোকা, সকালে আমায় যেতে হবে না!
ছোটকা তোমার ভাল শার্ট নেই?
হুঁ। আছে। মেসে।
তোমার ব্যাগে বাবার দুটো শার্ট ভরে দেব। খুব ভাল, দেখবে।
আরে পাগলি। দাদার অফিসে লাগবে।
তোমাকে আমি চাকরি পেয়ে খুব ভাল কিছু কিনে দেব। তখন নেবে না? ছোটকা হাসতে হাসতে বাথরুমের জলের কল খুলে দিয়েছে। হাসি আর জলের শব্দ। আমি বলে যাচ্ছি, চাকরি পেলে প্রথমেই তোমার কবিতার বই বেরোবে...।
ছোটকা তখনও হাসছে। হাসি আর জলের শব্দ। জল আর হাসির শব্দ। ছোটকা কিছুই শুনছে না। মিরুজিন নদীর তীরে বিবর্ণ প্রাসাদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ঝুঁকে আছে। জলে আগুনের শিখা দেখছে। জলের গভীরে।
এত সব ভাবছি, না স্বপ্ন দেখছি! তা হলে ঘুমোচ্ছি! ঘুমোচ্ছি কি? ধেড়ে, ভ্যাবলা পাখির মতো এসে বসেছে একটা ছেলে আমাদের ড্রয়িং রুমে। বছর তেইশের প্যাংলা যুবক। ওর একটা চাকরি চাই। ওর একটা চাকরি দরকার। কিন্তু কী যেন বলবে আমাকে ও!

ছয়
আজ রবিবার। বাবা-মা দু’জনেই বেরিয়ে গিয়েছে। বাজারে গেলে ফিরতে দেরি হয়। আমি একটু আগে চয়নকে ফোন করেছি, ওকে আসতে বলেছি। চয়ন আসবে।
সে দিন এসেছিল চয়ন। কী আশ্চর্য, ও কবিতা লিখছে ইদানীং। সে দিন ছোটকার খোঁজ করছিল। ছোটকাকে দেখাবে ওর লেখা। ছোটকার ফোন নম্বর চেয়েছিল। আমি ওকে পুরনো নম্বরটাই দিয়েছি। নম্বরটা আর নিশ্চিত ভাবে নেই জেনেও দিয়েছি। যদি কোনও দিন পেয়ে যায়। হঠাৎ!
সে দিন চয়ন বলেছিল, আমাদের বাড়িতে নাকি আসতে ওর ভয় করে।
আমি বলেছিলাম, কেন, ‘বিওয়্যার অব ডগ’ লেখা আছে নাকি?
তবু ভয় করে, ও বলেছিল।
কেন রে কেন রে কেন রে, আমার রাগ হয়েছিল। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, কেন রে?
চয়ন সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপসে গিয়েছিল।
আমি অবশ্য তার পরই হো হো করে হেসে উঠেছিলাম। বলেছিলাম, কবিতা শোনানোর জন্য আমাকে এত জরুরি পাঠক ভাবলি। আবার আমাদের বাড়ি আসতে ভয়ও ছিল। কেন?
জানি না।
আমি জানি।
কী?
আমাদের খুব বড় বাড়ি। আমার বাবা বেশ রাশভারী চেহারার মানুষ। আমরা মোটামুটি ধনী। আর তুই...
‘এই লেখাটা শোন’ বলে চয়ন প্রসঙ্গ থেকে পালাতে চাইল।
আমার রাগ হয়েছিল। বললাম, আমাকে দেখছিস। আমাদের দেখছিস। আমাদের এই চর্বি জীবন নিয়ে কিছু লিখতে পারিস না? আমি তার পর ওকে অবাক করে দিয়ে আমার টপের কিছুটা তুলে দিয়ে ফরসা পেট দেখিয়ে বলেছিলাম, সত্যিই চর্বি জমেছে দেখ!
চয়ন থমথমে মুখ নিয়ে ঝটিতেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল তুই বাড়িতে থেকে থেকে পাগল হয়ে যাচ্ছিস বীথি!
আমি কথাটার আকস্মিক প্রতিক্রিয়ায় কেমন নিয়ন্ত্রণহীন হেসে যাচ্ছিলাম। ওর মধ্যেই বুঝতে পারছিলাম চয়ন সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় নেমে যাচ্ছে।

সাত
চল্লিশ ইঞ্চি এল সি ডি-র পর্দায় এক জন সঞ্চালক তাঁর দু’পাশে দু’টি যুযুধান দলকে বসিয়ে রেখে দর্শকদের খেলা দেখাচ্ছেন। আমিও দেখছি। কথা শুনছি। রক্ত গরম হচ্ছে। রাগ হচ্ছে। পক্ষ নিচ্ছি। পক্ষ পাল্টে যাচ্ছে। খেলাটা আসলে চলছে। জমেছে। কুৎসা আর ধিক্কার একে অপরের প্রতি ছুটিয়ে দিচ্ছে। আসলে এই খেলাটাই সঞ্চালকের উদ্দেশ্য। খেলা দেখানোটাই। কোন গ্রামে রক্ত ঝরল। কত জন মারা গেল। এগুলো জাস্ট ইস্যু। কিন্তু টিভিটা হঠাৎ ঘুমিয়ে যাচ্ছে কেন? নাকি আমিই ঘুমিয়ে যাচ্ছি? সত্যি...?
দরজার বেল বাজল।
টিভিটা অফ করে দরজা খুলে দেখি, ছোটকা। আমি আশ্চর্য হয়ে কতদিন পর ছোটকাকে দেখছি। ছোটকাকে আমি জড়িয়ে ধরেছি। ছোটকা আমার চুলে হাত রেখে বলছে, তোর চুল তেমনই সুন্দর আছে। আর কী সুগন্ধ তোর চুলে!
আমি বললাম, তুমি ‘বনলতা সেন’ এক বার আবৃত্তি করো ছোটকা। কত দিন শুনিনি।
ছোটকা ভেতরে এল। ছোটকা। ধ্রুব বসু। একটা অস্পষ্ট মানুষ। একটা মলিন মানুষ।
ছোটকাকে দেখে বাবা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল। ছোটকা অবাঞ্ছিত? ছোটকার সঙ্গে বাবা কথা বলছে না কেন?
ঘুমটা আমার চটকে গেল। আমাকে এসে ঠেলা দিয়েছে চয়ন কী ব্যাপার, টিভি খুলে রেখে ঘুমোচ্ছিস?
আমি বললাম, ছোটকা। আমি ঘোরের মধ্যে বললাম।
তার মানে? কোথায় ছোটকা? এসেছেন?
হ্যাঁ। ঘুমের ভেতর।
পাগল!
আমি ভাবতে লাগলাম আমি কেন চয়নকে আসতে বলেছিলাম। কখন বলেছিলাম। চয়ন কি নতুন কিছু লিখছে?
কী রে, অমন হাঁ করে চেয়ে আছিস যে?
আমাদের গ্রামে যাবি চয়ন?
তোদের গ্রাম? মানে তোর সেজকাকু যেখানে থাকেন? কখনও গিয়েছিস তুই নিজে?
দু’এক বার। ছোটতে। এখন শুধু স্বপ্নে দেখি। আমার ভেতরে একটা গ্রাম জেগে আছে জানিস!
তুই একটা অদ্ভুত মেয়ে। তোর একটা ভাবনাবিলাস আছে বীথি।
আমি চোখ বুজলাম। চয়নকে সহ্য করতে পারছিলাম না। ভাবতে লাগলাম, কেন ওকে আসতে বলেছিলাম। কখন বলেছিলাম। চয়ন তো লেখা শোনাচ্ছে না। চয়ন ফিজিক্সে অনার্স। চয়ন বস্তি এলাকায় থাকে।
আমি চয়নের জন্য ফ্রিজ থেকে কিছু খাবার আনতে গেলাম ভিতরে। এক মিনিটের মধ্যে এসে দেখি ও নেই। টি-টেবিলের ওপর একটা কাগজে চিঠির মতো কিছু লেখা। ওটা আসলে ছোট একটা কবিতা।
চয়ন কী ভাবল? আমার কবিতা শোনার মুড নেই? ধৈর্য নেই? আমি চটজলদি ভেজানো দরজা খুলে বাইরে তাকাই। এক দিকে চয়নের সাইকেল ছুটে যাচ্ছে। আর রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি এসে গেটের সামনে দাঁড়াল। মা-বাবা বাজার থেকে ফিরল।

আট
আমি আর চয়ন আজ সারা দিন ঘোরাঘুরি করেছি। মাঠে, পুকুরপাড়ে। হাঁটতে হাঁটতে পাশের গ্রামের কাছাকাছি। কেমন একটা খোলা হাওয়া। খোলা নিশ্বাস। আমাদের শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয় এই গ্রাম। আমার কাছে যেন নতুন করে আবিষ্কার। পথে যেতে যেতে বাবলা গাছের তলায় শুয়েছি। মোবাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি। বোতল থেকে জল ঢকঢক করে গলায় ঢেলেছি। আর দেখেছি কত অল্প কিছু নিয়েও মানুষের চলে যায়। যত এ সব দেখেছি, তত বিষণ্ণ হয়েছি।
সারা দিনের শেষে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। টিউবওয়েলের ঘটাংঘট শব্দ। অদ্ভুত অন্ধকার। পাওয়ার নেই। মশার কামড় উঠোনে। দু’একটি বাচ্চা-বুড়োর অবাক তাকানো। শুকিয়ে ওঠা পুকুর এই জানুয়ারিতেও। গত বর্ষায় বৃষ্টি হয়নি। মেজকাকা মেজকাকিমার খাটুনি। আবার চাঁচের ঝুপড়িতেই ডিশ অ্যান্টেনা টাঙিয়ে দিব্যি আছে মানুষ।
ছোটকা আমার মধ্যে যে ঘোর তৈরি করেছে, এ সব দেখে সেই স্বপ্নের সঙ্গে তা মেলাতে পারি না। এ ভাবেও মানুষ বেঁচে থাকে! এর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আমি। গুমোট ভোগের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠি। ছটফট করি। কিছু একটা চাই। অন্য রকম কিছু একটা। জলের ভিতর নড়ে উঠছে শিখা। আমি দেখতে পাচ্ছি। গভীরে নেমে ছুঁয়ে আসার সামর্থ্য নেই। নেই... নেই... নেই... কথাটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ছোটকা তা হলে দূর থেকে আমাকে কীসের সন্ধান দিল! সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।
মনে হল, ‘সত্য সারাৎসার মূর্তি সোনার বৃষের ’পরে ছুটে সারা দিন
’হয়ে গিয়েছে পাথর এখন।

দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে আমি চয়নের বিছানায় এসে বসলাম। ঘুমন্ত চয়নের পিঠে হাত রাখার আগে ছোটকার কথা মনে পড়ল আবার, অন্ধকারে হঠাৎ। ছোটকা কোথাও নেই। ছোটকা কোথাও নেই। মিরুজিন নামে কাল্পনিক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে, বিবর্ণ প্রাসাদ নাকি ছোটকা? মিরুজিন কোথাও নেই। ছোটকা কোথাও নেই, তবু ছোটকা একটা সাময়িক বাতাস যে মাঝে মাঝে নেড়ে দিয়ে যাবে, উলঢাল করে দিয়ে যাবে সাজিয়ে রাখা জীবনযাপনের ঝকমকে চুল।
আমি চুল খুলে দিলাম। অন্ধকারে কেউ তা দেখতে পেল না। শুধু চয়ন, ওর মুখে সুড়সুড়ি লাগায় নড়েচড়ে উঠল।


ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.