|
|
|
|
|
|
|
লিংডু, ছোরা আর জোমোর দেশে |
সেখানে লাল ভেড়া বলি দিয়ে পুজো হত ‘সাওনি দেবী’র। বলা হত, ভাল মনে আত্মার স্মৃতিতে
খাবার দিলে উড়ে
আসে কাক।
দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে সেই নানান বিশ্বাসমাখা জীবনযাত্রার হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় হাঁটলেন রুনা বসু।
|
মেষপালকের দল তার গ্রীষ্মকালীন চারণক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়ার আগে, সবাই একত্রিত হয়ে একটা পূজা করা আবশ্যক ছিল, যা ‘সাওনি পূজা’ নামে পরিচিত। ‘লাল ভেড়া’ বলি দেওয়াই এই পূজার মাহাত্ম্য। এখানে জঙ্গলবিহীন পাহাড়ে ভেড়ার পাল চরতে চরতে যখন কোনও ভেড়া হঠাৎ হারিয়ে যেত, এঁরা বিশ্বাস করতেন, সাওনি দেবী লুকিয়ে রেখেছেন। এ সব আর নেই, শুধু পূজাপার্বণ রয়ে গেছে। পশুপালনই ছিল কিন্নর জনজাতির সংস্কৃতির অঙ্গ, তা আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।
মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম এবং স্থানীয় লোকাচার অনুযায়ী মৃত্যুর ১২ দিনের দিন বা ১৫ দিনের দিন পূজা হয়। শ্মশানে মেয়েরা যান না। মৃত্যুর পর এক দিন পূজাপাঠ করে তবে দেহ পোড়ানো হয়। এই ১২ বা ১৫ দিন রোজ ভিক্ষুণীরা পূজা করেন এবং মৃত আত্মার জন্যে খাবার দেওয়া হয়। বলা হয়, ভাল মনে খাবার দিলে অনেক কাক আসে খেতে। শেষ দিন বড় লামারা এসে মৃত ব্যক্তির একটা মূর্তি জ্বালিয়ে দেন, আর এর পর থেকে ওই ব্যক্তির কথা কেউ মনে করেন না। এঁরা বিশ্বাস করেন, মৃত ব্যক্তিকে মনে করলে আত্মা আবার ফিরে আসে, আবার পূজা করতে হয়। মৃতাত্মাকে ডাকার একটি দিনও আছে। তার গল্পটা এই রকম: বহু আগে মৃতাত্মারা বছরের এক নির্দিষ্ট দিনে, এক নির্দিষ্ট জায়গায় শরীর ধারণ করে দেখা করতে আসত। গ্রামের সবাই প্রিয়জনের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যেত। সবাই সারারাত নাচ করত আর ভোর হলে আত্মারা চলে যেত। নিয়ম ছিল, হাত না শুকোলে যেতে পারবে না। এক বার একটি মেয়ে তার প্রিয় ভাইকে যেতে দেবে না বলে হাত ধোয়ার জন্য জলের বদলে ঘি দেয়। আর হাত শুকোতে না পেরে ভাই ফেরত যেতে পারে না, খুব কষ্ট পায়। তার পর থেকে আত্মা এলেও আর শরীর ধারণ করে না। কেউ কেউ বলে, বন ধর্ম যা তিব্বতের আদি ধর্ম, তা থেকে এই উৎসব এসেছে। ফেরার পথে আমরা চেরি বাগানে এলাম। ফল খেতে খেতে জানলাম, কেয়ারটেকার ছাড়া সবাই স্থানীয় ঠিকে শ্রমিক। কলকাতার নাম জানেন কেয়ারটেকার। একলা এত দূরে আসার কথা শুনে অবাকই হলেন, সাবধানে থাকতে বললেন।
ঘরে এসে ‘লিংডু’র গোছা (ঢেঁকি জাতীয় শাক) আর কাপড় দেওয়া হল। এই শাক ধুলে হয় না, শুকনো কাপড় দিয়ে ছোট ছোট রোঁয়া পরিষ্কার করে নিতে হয়। পেঁয়াজ, রসুন সঙ্গে ‘ছোরা’ বা শুকনো পনির দিয়ে রান্না করলে খেতে ভাল হয়। এত দিনে এই প্রথম কাঠের জাল দেওয়া উনুনের পাশে, গালিচা পাতা কাঠের রান্নাঘরে বসে গরম গরম রুটি আর সুস্বাদু লিংডুর তরকারি খেলাম। এরা শীতকালে রাতে এখানে শোয়ও।
পরের দিন কাঠ সংগ্রহের কাজে অ্যানি চলে গেলেন। আমি আর অ্যানির সাথি রুটি ও নম্কিন চা করে রাখলাম, গ্রামের সবাই এসে খাবেন। নাম না জানা গাছের শুকনো ছাল দিয়ে চা বানানো হল। মেয়েটির নাম আমার মনে নেই, অ্যানির কাছে থাকে। বিয়ে হয়নি, হয়তো পরে জোমো হবে, এ রকমই অ্যানির ইচ্ছা। মেয়েটি জানাল শুধু মন্দির নয়, গ্রামে খেতের কাজেও এই রকম সাহায্য পাওয়া যায়। তবে যারা নেপালি রেখে কাজ করান, তাঁরা আলাদা। এঁদের মধ্যে দেশি বীজেরও (রাজমা, মাক্কি) আদানপ্রদান চলে। আজকের দিনের স্কুলে যাওয়া ছেলে মেয়েরা, বিশেষ করে সচ্ছল পরিবারের, বেশি খেতে যায় না; কিন্তু কাজ জানা নেই, এ রকম কাউকে পাওয়া যাবে না। এখানে মেয়ের বিয়ে দিতে কেউ ছেলের বাড়িতে যান না, ছেলেরাই আসে। ছেলে মেয়ে দু’জনেরই জমির কাজ জানা চাই; পড়াশুনো এমনকী সরকারি চাকরি থাকলেও জমির কাজ জানতে হবে। রোজগার সবই হয় জমি থেকে, চাকরি করে আর কতটুকু পাওয়া যায়? যাঁর হাতে বেশি টাকা, পাঠাচ্ছেন ছেলে মেয়েদের হস্টেলে, ইংরেজি পড়তে। কিন্তু ভাল চাকরি আর ক’টা হয়, সব হয় ছোট চাকরি নয় ব্যবসা। |
|
অ্যানি তাঁর নিজের কথা বলতে চাইলেন না। জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলেন, আমি আর কতটুকু জানি যে বলব? এই পুজো আর সবার অসময়ে পাশে থেকে দিন কাটাই। মেয়েটি জানাল, অ্যানি ছিলেন বাড়ির বড় মেয়ে, খেতের কাজ করা, ঘরের ছাগল-ভেড়া চরানোর দায়িত্ব ছিল। সামনের পাহাড়ের একটা বড় পাথর দেখিয়ে বলল, সকালের আলো ওখানে পড়লে আমরা দল বেঁধে খেতের কাজে যেতাম আর সূর্য পাহাড়ের পিছনে গেলে ফিরে আসতাম। ছেলের বাড়ি থেকে কথা বলে অ্যানির বিয়ে হয়েছিল। তখন বয়স বছর ষোলো। বিয়েতে মত ছিল না, কিন্তু ভয়ে বলতে পারেনি। বিয়ের পর শ্বশুরঘরে গিয়েই পরের দিন পালিয়ে জাঙ্গির বৌদ্ধ মন্দিরে চলে যায়। ওখানকার ভিক্ষুণীদের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। চুল কেটে, লাল কাপড় পরে ভিক্ষুণী হয়ে যায়। বেশ কিছু বছর পরে পুঁথি পাঠ ও পূজা শিখে গ্রামে ফের আসে। প্রথমে একটা ছোট্ট মন্দির ছিল, ধীরে ধীরে অ্যানির সুন্দর ব্যবহারে লোকে ধর্মচর্চা শিখেছে। অ্যানির বয়স এখন ৫৪ বছর। আমাদের এখানে বিয়ে হওয়া আর ভেঙে যাওয়াতে বিশেষ সামাজিক বাধা নেই। আইন পঞ্চায়েতের কথা মানে আর পঞ্চায়েত গ্রাম দেবতাকে মানে। নিচু জাতের কাউকে বিয়ে করলে ঘর আলাদা হয়ে যায়। ধর্ম যাই হোক, সমাজের নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয়।
এই গৃহী জোমোদের সম্পর্কে অনেকে বলে, এঁরা ছলচাতুরি করে টাকা রোজগার করে নিজের পরিবারের সম্পত্তি বাড়ান। এ বিষয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। এ বার বাড়ি ফেরার সময় অ্যানি মন্দির থেকে সুন্দর একটি বুদ্ধ মূর্তি এনে আমার হাতে দিলেন আর মাথায় পরালেন কিন্নরী টুপি ও খাতাক (তিব্বতি ভাষায় সন্মানীয় উত্তরীয়)। বললেন, মন্দিরে প্রদীপ জ্বেলে যাও, মূর্তিটা তোমার কাছে রেখো।
এক বছরের মাথায় ফিরে আসি হিমাচলে। যাই রিকংপিওতে, কিন্নর জেলার সদর শহর। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘কিন্নর দেশে’ থেকে জানা যায়, একদা দেব অধ্যুষিত এই ভূপৃষ্ঠে একদল অনুন্নত মানুষ এসে বাস করতে লাগল...। এখানকার মানুষ তা বিশ্বাস করেন না। পরিচয় হয় রিব্বা গ্রামের কুমারী রতনমঞ্জরীর সঙ্গে। সমাজসেবী আর রাজনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত। একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাও চালান। কিন্নরী আদিবাসী মহিলাদের জমির অধিকার নিয়ে লম্বা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন গত ৪ দশক ধরে। এঁরা গৃহী লামাদের মতো গৃহী জোমোদের জমির অধিকার নিয়েও কথা বলেন। সম্পত্তিতে আইনি অধিকার না থাকলেও কেউ চাইলে মেয়ের নামে জমি লিখে দিতে পারে। আবার বিয়ের সময় ‘বিথোপোনো’ পদ্ধতি অনুযায়ী স্ত্রীর জন্যে সম্পত্তি চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এ জমি শুধু ব্যবহার করা যায়, বেচা যায় না। বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে অন্যকে বিয়ে করার আগে পর্যন্ত মেয়েটির এই অধিকার থাকে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে জমি হস্তান্তর হচ্ছে না। যে বাড়িতে ভাইরা দায়িত্বজ্ঞানহীন সেখানে অবিবাহিত বোনেদের অবস্থা খুব খারাপ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তার কথায়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। বর্তমান প্রজন্ম গ্রামের বাইরে থাকতে চায়। শুধু উপার্জন ছাড়া অন্য কোনও সামাজিক দায় নিতে চায় না।
সবাই অবশ্য এ বিষয়ে একমত নন। তাঁদের মতে, জমির অধিকার না থাকলেও চাষ করে জমি থেকে যে রোজগার হয় তার ভাগ মেয়েরা পায়। সরকারি খাস তালুকের জমি চাষের জন্য লিজ নেওয়ার ব্যবস্থা আছে মেয়েদের জন্যেও। মেয়েরা জমির অধিকার পেলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলেও মত আছে। আরও জানা গেল, হিমাচল রাজ্য গঠনের সময়, কিন্নরবাসী ঠাকুর সেন নেগীর উদ্যোগেই এই অঞ্চলের বাসিন্দারা তফসিলি জাতিভুক্ত হন এবং কিন্নর জেলার সীমা মারয়টীধার পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়। HIMACHAL PRADESH NAUTOR RULES, 1954-এ তফসিলি জাতি-জনজাতির কোনও উল্লেখ নেই। তা হলে কোন অর্থে এঁরা আদিবাসী? উত্তর মেলে না।
রিকংপিও থেকে প্রায় চার ঘণ্টার রাস্তা আসরং গাঁও। এখানকার নিবাসী শ্রীমতী নাগ্মা ডোলমার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নেগীজির বাড়িতে, সম্পর্কে নেগীজির মা। নিজের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের শরীরের ওপর তাঁর কড়া নজর। উনি কিন্তু নিশ্চিন্তে আছেন ওঁর মূক ও বধির মেয়ে জাংমোকে নিয়ে। বললেন, এই কালা বোবা মেয়েকে ভগবান আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন সেবা করার জন্যে। আমাদের গ্রামে আরও দু’এক জন এ রকম আছে। তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কারও কারও আবার পা মোড়া হয়। চন্দ্র গ্রহণের সময় পোয়াতি ঘর-বার করতে গিয়ে ভয় পেলে তার পেটের বাচ্চার পা মুড়ে যায়। দু’বছর হল আমার বুড়া (স্বামী) মারা গেছে। জাংমো ওর বাবার খুব সেবা করেছে। ও না থাকলে আমি মরেই যেতাম। আমার বুড়া বলত, ‘আঁখি নেই তো সংসার চলে গেল/ দাঁত নেই তো স্বাদিস চলে গেল’। এই বলে তিনি মেয়ের হাত ধরে তাকে নমস্কার জানালেন। তা দেখে মেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সম্পর্কটা অধিকারের নয় বোঝাপড়ার, সম্মানের।
নেগীজির মা আর ও বললেন যে তিনি মিষ্টি খুব কম খান পাছে বুড়ো বয়সে বুড়ার মতো সব দাঁত চলে যায়! ওঁর বিয়ের গল্প করতে বললে লাজুক লাজুক মুখে বললেন, কত জমিদারের ঘরের সম্বন্ধ এল। এক জনের তো অনেক জমি ছিল, ঘর কত বড়, আমি ভয় পেলাম। এই ছোট্ট মেয়ে আমি, গোঠাং-এ (জাঁতা) গম, জো, কোলে পিষতে পিষতে আর রুটি বানাতে বানাতে মরেই যাব। রাজি হলাম না। আর এক জন ছ’মাস রেখেছিল, তাকে আমার পছন্দ হয়নি। মা নিয়ে এল। আর এক জনের ঘরে দু’রাত কাটাই, সেখান থেকেও চলে আসি, আমার পছন্দ নয়। আমাদের সময় এ রকমই হত। আমার মাসি তখন মা’র সঙ্গে কথা বলে এক ফোয়ালের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। আমি তাকে চিনতাম না। রাত কাটতেই বেরিয়ে পড়লাম, চললাম ভেড়ার পালের সঙ্গে; সবার আগে, হাতে একটা ছড়ি নিয়ে, যেমন আমরা যাই আর কী। অনেক বেলা হওয়ার পর আলো খুলতে মনে হল এক বার দেখি কার সঙ্গে এলাম। হায় ভগবান! দেখি সবার পিছনে একটা কালা মতন লোক আসছে। এত ভাল ভাল থাকতে শেষে কিনা এই! এই আমার কপাল। বুড়া বড় মেজাজি ছিল। আমাকে ভাগিয়ে দিলে দূরে পাথরের আড়ালে বসে দেখতাম। যখন আর ছেলেপিলে সামলাতে পারত না, তখন এসে রান্নাঘরে উনুনের সামনে বসতাম।
মেয়েরা বলল, মা কোনও দিন বাবার মুখে মুখে কথা বলেনি। বাবা বক বক করত আর মা চুপ করে থাকত। উনি বললেন, দূর, বলে কী হবে, ছিলই ও রকম আর কী। আমার মনে একটা প্রশ্ন এল: এই মহিলার কথাগুলোর সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মেয়েদের বোধের কি কোনও তফাৎ আছে? নেগীজির মা আরও বললেন, এক বার আমরা বিলাসপুরে গিয়েছিলাম, ওই ভেড়ার পালের সঙ্গে। ওখানে কুল্লু থেকে আসা এক জন আমাকে টাকা দিয়ে বলল, তোমায় পরে এসে নিয়ে যাব। আপনি টাকা নিলেন? প্রশ্ন করলাম। খিলখিলিয়ে প্রাণখোলা হাসি হেসে বললেন, হ্যা।ঁ আবার এক বার তো আর এক জন নিয়ে যেতে চাইল, আমার হাত ধরে টানাটানি। আমি এক বুড়ির হাত চেপে ধরে ধরে জোরে জোরে বললাম, যাব না যাব না। তখন ছেড়ে দিল। ততদিনে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এই রকমই আমাদের জীবন। |
|
আজকের দিনেও নিজের বিয়েতে পালিয়ে যাওয়া বা তুলে নিয়ে যাওয়া ঘটে থাকে। এর মধ্যে ক্ষমতার সঙ্গে লুকোচুরির, হয়তো বা যৌনতা আর অধিকারের নানান গল্প আছে, যার সবটা খুব সরল ভাবে বোঝার চেষ্টা করে আমরা বারবার ভুলই করি। নেগীজির সঙ্গে আলাপচারিতায় ওই সমাজের মেয়েদের অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা জানলেও বলব, ওঁর লেখায় যে নারী স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তা পুরো বাস্তবের ছবি নয়। নানান ফাঁক ফোকর আছে। আসলে আমাদের বইয়ের ইতিহাস তো এই ভাবেই লেখা হয়ে থাকে, অনেকটাই যেন বাইরে থেকে, তাই ভেতরের সব দেওয়া-নেওয়াগুলো, আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের ক্ষমতা/অক্ষমতার আদানপ্রদান আমরা ধরতে পারি না।
যেমন হিমাচলের জন্মলগ্নে, ১৯৬০ সালে রামপুর বুশহর ভিন্ন হল কিন্নর থেকে। নতুন জেলা তৈরির সময় ঠাকুর সেন নেগী শুধু আর্থিক সুবিধের জন্য কিন্নরীদের তফসিলি জনজাতিভুক্ত করেন আর সারহানের বীরভদ্র সিংহ (রামপুর বুশহরের দেশীয় রাজা পদ্মম্ সিংহ-এর পুত্র) নিজে তফসিলি জনজাতিভুক্ত হবেন না বলে, কিন্নর থেকে রামপুরকে আলাদা করেন। এই বদলের ফাঁকে পড়ল মেয়েরা, হারাল জমির অধিকার। এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা কোথায়? এই প্রশ্ন আমি শুনতে পেলাম, সেই রিব্বা গ্রামের কুমারী রতনমঞ্জরীর ডাকা একটা সভায়।
এখানে বহুপত্নী এবং বহুপতি প্রথা প্রচলিত। আবার সন্তানসম্ভবা নারীকে বিবাহ বা বিধবা বিবাহ সবই সমাজ তথা পঞ্চায়েত এবং গ্রাম দেবতা দ্বারা স্বীকৃত। প্রয়োজন অনুযায়ী দণ্ড ব্যবস্থা রয়েছে, দেবতার সম্মতিতে। ছেলে-মেয়ে কার, এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। ভ্রূণহত্যার কথা শোনা যায়নি। নানান অসম ব্যবস্থা সত্ত্বেও মেয়েরা যেন শ্বশুরবাড়িতে সমাদৃত। দেখা যাক বিবাহ গীতের কথা:
মাইটেয়ু থোগিস গোরছঙ,
অমাউ জাগাও য়ুমেত;
অমাউ জাগাও য়ুমেত, বপুউ জাগাও রু।
বপুউ জাগাও রু, দাবচেও জাগাও বোরে;
দাবচেও জাগাও বোরে,
য়ুঙজেও জাগাও প্রইমী।
অর্থাৎ
বাপের বাড়ির মতো শ্বশুরঘর পেলে, মায়ের জায়গায় তোমার শাশুড়ি।
মায়ের জায়গায় তোমার শাশুড়ি, পিতার জায়গায় তোমার শ্বশুর,
পিতার জায়গায় তোমার শ্বশুর, বড় বোনের জায়গায় বড় ননদ,
বড় বোনের জায়গায় বড় ননদ, ভাইয়ের জায়গায় এখন স্বামী।
প্রবাদ আছে—
জই প্রয়ে শরে,
ডুম্বোর ডেলিঙো।
অর্থাৎ
মেয়ে শ্বশুরঘরে সুন্দর, দেবতা দেবালয়।
বিবাহ গীতে এও শোনা যায়
নিঙোনু গোঙগ্যালীচ, অসে দুসে তচিমা।
অসে দুসে তচিমা, ফরনা য়পয়প জারইঁ।
ফরনা য়পয়প জারইঁ, কিন জঙূচো মইটে।
কিন জঙূচো মইটে, কিন য়ূঙজেচু ধুরে।
কিন য়ূঙজেচু ধুরে কিন বপুচু বায়ে।
অর্থাৎ
আমার মেয়ে, শ্বশুরঘরে অবিচার করে তো,
শ্বশুরঘরে অবিচার করে তো,
ফুড়ুৎ করে উড়ে আসবে,
ফুড়ুৎকরে উড়ে আসবে,
নিজের ভাল বাপের ঘরে,
নিজের ভাল বাপের ঘরে,
(বসবে) নিজের ভাইয়ের ডাঁয়ে,
(বসবে) নিজের ভাইয়ের ডাঁয়ে,
(বসবে) নিজের পিতার বাঁয়ে।
রিকংপিওতে এক কলেজ অধ্যাপকের কাছে জানলাম, আপেল, মটরের বাজার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকের হাতে অনেক টাকা আসছে। বাচ্চারা কেউ কেউ স্থানীয় বা জেলার বাইরে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের মাস্টারদের মতে ছেলে মেয়েদের শাসন করলে বা পাশ করাতে না চাইলে, বাবা-মা প্রতিবাদ করেন, স্থানীয় নেতার সাহায্য নেন। পড়াশুনোর বেহাল অবস্থা। কিন্নরের চাঙ্গো গ্রামের সরকারি শিক্ষক জানালেন, ছেলের জন্ম হলে গ্রামের সবাইকে পুরি বিলোনো হয় আর ঢেঁড়া পিটিয়ে সবাইকে জানানোও হয়, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছু করা হয় না।
এখন আবার এলাকায় অনেকেই নতুন নতুন নেশায় বুঁদ হচ্ছে, বিশেষ করে যুব সমাজ। অতুল (নাম পরবর্তিত) আমার অত্যন্ত পরিচিত। ছেলেটি ক্লাস এইট-এ স্কুল ছেড়েছে, আর কত দূর পড়বে জানা নেই। স্থানীয় গ্যারাজে কাজ শিখছে, টাকাও পাচ্ছে কিছুটা। ও বলল, গাঁজা পাতা থেকে কালো কালো পুরিয়া বানাতে জানে, ফেভিকল আর গাড়ির নোংরা কাপড় পুড়িয়ে নেশা করে। দেশি ও বিদেশি সব রকম মদ পান করে ওর বন্ধুরা। এ ক্ষেত্রে গ্রাম দেবতা মনে হয় নিরুপায়। গ্রহের ফের আর অন্যের কুনজরের জন্যেই এই অধঃপতন মেনে নিয়ে পূজা পাঠের প্রচলন বেড়ে যাচ্ছে।
উন্নয়নের মাপ কাঠিতে হিমাচলপ্রদেশ আজকে ভারতের প্রথম সারির রাজ্যের মধ্যে একটি। ১৯৭১ সালে এই রাজ্য পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়। মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে তৃতীয় বার পেল IBN7 DIAMOND STATE AWARD ২০১১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। আপনি পর্যটক হলেও চাইলে যে কোনও সরকারি দফতর, স্কুল, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এঁরা অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। আপনার কথা শুনবেন ধৈর্যের সঙ্গে। কোনও ধরনের হঠকারিতা বা আক্রোশের প্রতিবাদ জানাবেন।
বলতে ইচ্ছে করছে, এখানে গ্রাম সমাজ জীবন্ত। সম্পর্কের স্বাচ্ছন্দ্য এখনও মুক্ত সমাজের অস্তিত্বকে ধরে রেখেছে। টাকা রোজগারের ঝোঁক বাড়লেও জমি বেচার আগ্রহ এখনও কম দেখা যায়। বাইরের জগৎ কী ভাবছে, তা নিয়ে বেশির ভাগের মাথা ব্যথা কম। পোশাকআশাকে আর ব্যবহারে পরিবর্তন এলেও অনেকের বিশ্বাস এটা তাৎক্ষণিক। ভোটের রাজনীতি কিছু সাময়িক সুবিধের জন্য টিকে আছে, বরং ধর্মীয় সমাজ অনেক বেশি সক্রিয়। সমাজ সংস্কৃতির মাপকাঠিতে সমৃদ্ধ একটি রাজ্য এক পরম্পরাকে বয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কোন মাপকাঠিতে এই রাজ্য ডায়মন্ড স্টেটের আখ্যা পেল, জানার ইচ্ছে নিয়ে তৃতীয় বার হিমাচল ছাড়লাম। শিমলায় ফেরার পথসঙ্গিনী বললেন, যতক্ষণ খেটে খাওয়ার মানসিকতা এবং মূল্যবোধ টিকে থাকবে, ততক্ষণ এ ব্যবস্থা ভাঙার নয়। আলস্যই একমাত্র শত্রু।
|
Reference :-
• Kinnaur Lok Sahitya. written by Dr. Bansi Ram Sharma.
• Vipasha- 150 January-February 2011 Vasha evam Sanskriti Vibhag, Himachal Pradesh.
• The Nomadic Shepherds of North-West Himalayas: In The Context of Kinnaur (A socio-cultural study) written by Vidyasagar Negi.
|
প্রতীচী ট্রাস্ট-এর একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত |
|
|
|
|
|