রাজ্যে পালাবদলের পরে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় জড়িয়ে হইচই ফেলেছিল রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ।
৫ জানুয়ারির সেই ঘটনার পরে ওই কলেজে আপাত শান্তি ফিরলেও তা যে নিতান্তই সাময়িক, বৃহস্পতিবার কর্মচারী সমিতির কয়েক জন সদস্যের হাতে ফের অধ্যক্ষ নিগ্রহের অভিযোগ তা প্রমাণ করল।
শুধু তাই নয়, পাঁচ মাস আগে তদানীন্তন অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকার নিগ্রহের ঘটনায় জড়িয়েছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ-সহ দলের তাবড় নেতাদের নাম। এ দিনও, কলেজের কমন রুমে ঢুকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শত্রুঘ্ন সিংহকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি তপন নাগ, রায়গঞ্জ শহর তৃণমূল কমিটির প্রাক্তন সভাপতি।
তপনবাবু অবশ্য একা নন, তাঁর তিন অনুগামী-সহ কলেজের কর্মচারী সমিতির সম্পাদক সুব্রত চক্রবর্তীও ওই ঘটনায় জড়িতে বলে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন শত্রুঘ্নবাবু।
তবে শিক্ষায়তনে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা ‘রাজনীতির দাপাদাপি’র ঘটনায় স্পষ্টই অস্বস্তিতে তৃণমূল। এ দিনের ঘটনার পরে উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি অমল আচার্যের কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, “ওই কলেজের কর্মচারী সমিতিতে দলের প্রভাব নেই এমন নয়, অনেকেই আমাদের সমর্থন করেন। তবে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় দলের কোন নেতা-কর্মী জড়িয়ে থাকলে দল তার পাশে দাঁড়াবে না।” |
শত্রুঘ্নবাবু একা নন, রায়গঞ্জ থানায় কর্মচারী সমিতির পক্ষ থেকে পাল্টা নিগ্রহের অভিযোগ করা হয়েছে শত্রুঘ্নবাবুর বিরুদ্ধেও। সমিতির সম্পাদক সুব্রতবাবুর অভিযোগ, অধ্যক্ষের কনুইয়ের গুঁতোয় আহত হয়েছেন তিনি। শত্রুঘ্নবাবু আপাতত রায়গঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি। পরে সমিতির নেতা-কর্মীরা সুব্রতবাবুকেও ওই হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। উত্তর দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডেভিড ইভান লেপচা বলেন, “ঘটনাটি নিতান্তই কলেজের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সঙ্গে শিক্ষাকর্মীদের গোলমাল হয়েছে। দু’পক্ষের সঙ্গেই বিশদে কথা বলা হবে। তার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া কথা ভাবা যাবে।”
কী হয়েছিল এ দিন?
এ দিন সকালে কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম বিলির শুরু হয়। নিজের ঘরে বসে ছিলেন শত্রুঘ্নবাবু। শিক্ষকদের অনেকেই জানান, আচমকা সেখানে হন্তদন্ত হয়ে ঢোকেন সমিতির দুই নেতা সুব্রতবাবু ও তপনবাবু। সঙ্গে আরও জনা তিনেক সমিতির সদস্য। শত্রুঘ্নবাবুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা জানতে চান, কেন সমিতির সঙ্গে আলোচনা না-করে ফর্ম বিলি সংক্রান্ত দায়-দায়িত্ব বন্টন করলেন অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষের টেবিল চাপড়াতেও দেখা যায় তাঁদের। ক্ষোভের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শত্রুঘ্নবাবু সমিতির নেতাদের স্পষ্টই জানিয়ে দেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কে কোন কাজ করবে তা নিয়ে সমিতির সঙ্গে আলোচনা করতে তিনি বাধ্য নন। পারদ চড়তে থাকে। বেগতিক দেখে শত্রুঘ্নবাব এ বার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে কমন রুমে ঢুকে পড়েন। সেখানে উপস্থিত শিক্ষকেরা দেখেন, শত্রুঘ্নবাবুকে ঘিরে থাকা সমিতির নেতাদের মধ্যে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। তিনি ছিটকে পড়েছেন মেঝেতে। তাঁর মাথা দেওয়ালে ঠুকে যায়। থতমত খেয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে ফের পড়ে যান শত্রুঘ্নবাবু। ছুটে আসেন শিক্ষকেরা। তাঁরাই ধরাধরি করে তাঁকে হাসপাতালে পাঠান। সেখানে তাঁর মাথায় সিটি স্ক্যান করানো হয়। |
রাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, “শিক্ষাকর্মীদের একাংশ ঠিক মতো কাজ করেন না। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ সবের প্রতিবাদ করছি। তা ছাড়া, সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে কাজের দায়িত্ব বিলি করতে যাব কেন? আমাকে সরানোর জন্য অনেক দিন ধরেই ওঁরা চক্রান্ত করছেন।” শত্রুঘ্নবাবু জানান, ওই পাঁচ কর্মীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে সমিতির নেতা তপনবাবু স্পষ্ট বলছেন, “আমি তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে আমার বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ বার বার মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন।” কেন? তার কোনও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। তপনবাবুর বিরুদ্ধে শিক্ষক নিগ্রহের অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। এর আগেও কলেজের এক শিক্ষকের কাছে ‘তোলা’ আদায়ের জন্য হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সমিতির পক্ষে সুব্রতবাবুর দাবি, “শত্রুঘ্নবাবু আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে নিজের ইচ্ছে মতো শিক্ষাকর্মীদের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা সে ব্যাপারেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। উনিই উল্টে আমাদের উপরে চড়াও হন।”
এ ঘটনায় তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করেছেন স্থানীয় সাংসদ দীপা দাসমুন্সির ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, “শুধু রায়গঞ্জ নয় গোটা রাজ্যেই শিক্ষার পরিবেশটাই নষ্ট করে দিয়েছে তৃণমূল।” আর, এ দিনের ঘটনা শুনেছেন শত্রুঘ্নবাবুর পূর্বসূরী দিলীপ দে সরকারও। তাঁর সংক্ষিপ্ত আক্ষেপ, “কলেজের শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে গিয়ে নিগৃহীত হয়েছিলাম। ফের একই ঘটনা ঘটল। এর শেষ কোথায়!” |