জঙ্গলমহল-সহ পশ্চিমবঙ্গের ছ’টি আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায় স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্পে আপাতত টাকা জোগাবে না কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, জুলাই থেকে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ বন্ধ হচ্ছে।
মূলত মা ও শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে ২০০৭-এ প্রথমে জলপাইগুড়ি, পরে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম ও দক্ষিণ দিনাজপুরে এই ‘ট্রাইব্যাল হেল্থ প্রজেক্ট’ শুরু হয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বার যত্ন, তাঁকে প্রয়োজনীয় ওষুধ-ইঞ্জেকশন দেওয়া থেকে শুরু করে প্রসব, এবং পরে শিশুর টিকাকরণ সবই এর আওতায়। এ ছাড়া বিভিন্ন মোবাইল ক্যাম্পে অন্যান্য রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাও থাকে। সরকারি-সূত্রের মতে, ছ’জেলার প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে বুনিয়াদি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অনেকটাই এই প্রকল্পের উপরে নির্ভরশীল।
এ দিকে রাজ্যের নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গোড়া থেকে মা ও নবজাতকের মৃত্যু-হার কমানোয় জোর দিয়েছেন। আদিবাসী এলাকার স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতেও তিনি দিয়েছেন গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি। কিন্তু নতুন সরকারের বছর না-ঘুরতেই আদিবাসী অঞ্চলে মা-শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষায় চালু কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি বন্ধ হতে বসায় বিস্তর প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। দিল্লির কাছে এর কারণ জানতে চেয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীকেও যারপরনাই ক্ষুব্ধ করেছে বলে দফতর সূত্রের খবর।
তবে এই মুহূর্তে রাজ্যের ওই ছ’টি জেলায় আদিবাসী স্বাস্থ্যরক্ষার বিকল্প উপায় কী হবে, তার স্পষ্ট কোনও দিশা স্বাস্থ্য-কর্তারা দিতে পারছেন না। কারণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সাফ নির্দেশ: রাজ্যে ট্রাইব্যাল হেল্থ প্রজেক্টের যাবতীয় কাজ ৩০ জুনের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারও ছ’টি জেলায় সংশ্লিষ্ট দফতরকে বলেছে কাজের রিপোর্ট জমা দিতে। প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের কতটা খরচ হয়েছে, সেই হিসেব দাখিলের পাশাপাশি অব্যবহৃত টাকা অবিলম্বে ফেরত দেওয়ার নির্দেশও জারি হয়েছে।
কিন্তু মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগড়, তামিলনাড়ুর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যেও তো প্রকল্পটি চলে। এবং দিল্লির খবর, সেখানে কোথাও প্রকল্প বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়নি! শুধু পশ্চিমবঙ্গে কোপ কেন?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পাঠানো প্রকল্পগুলো নিয়ে আমাদের কিছু সংশয় রয়েছে। দেখা হচ্ছে, একই ধরনের একাধিক প্রকল্প চালানোর যৌক্তিকতা কতটা। তাই আপাতত এই সিদ্ধান্ত।” উল্লেখ্য, টাকা খরচ করতে না-পারায় রাজ্যের মৎস্যচাষ ও পশুপালনে চলতি অর্থবর্ষে বরাদ্দ বন্ধের হুমকি দিয়েছে কেন্দ্র। এ বার আদিবাসী স্বাস্থ্য প্রকল্পেও কেন্দ্রীয় বরাদ্দে এ হেন ‘স্থগিতাদেশ’ প্রশাসনিক মহলে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তেমন শঙ্কিত করে তুলেছে সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও, যাদের উপরে প্রকল্পটি চালানোর দায়িত্ব বর্তেছিল রাজ্য। কী বলছে তারা?
সংগঠনের কর্মীরা জানিয়েছেন, এত দিন ধরে তিল তিল করে তাঁরা যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত তাতে এক বড়সড় ধাক্কা। সংগঠনের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা পাপিয়া সেনের কথায়, “ট্রাইব্যাল হেল্থ প্রজেক্টের দৌলতে বেলপাহাড়ির মতো জায়গাতেও স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর চেহারাটা আকাশ-পাতাল বদলে গিয়েছে! অনেকটা এগোনো গিয়েছিল। জানি না, এ বার কী হবে।” প্রকল্পে শ’পাঁচেক আদিবাসী মহিলাকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরাও রাতারাতি বেকার হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজ্য কী ভাবছে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দফতরের কমিশনার দিলীপ ঘোষের দাবি, “উপজাতি এলাকায় স্বাস্থ্য-পরিষেবার কাজ কোনও ভাবেই থমকে যাবে না। আমাদের একাধিক প্রকল্প চলে। তার মধ্যেই উপজাতিদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রকল্পের কাজগুলোকে ঢুকিয়ে নেওয়া হবে।”
এই আশ্বাসেও বিশেষ আশাবাদী নন স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য: উপজাতিদের ভাষা, সংস্কৃতি ভিন্ন। স্বাস্থ্য-চাহিদার প্রকৃতিও আলাদা, যা মেটাতে নিরন্তর প্রয়াস দরকার। “গত ক’বছর সেই চেষ্টাই চলছিল। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ব্যাহত হবে।” — মন্তব্য এক অফিসারের। |