|
|
|
|
মেয়ের সাফল্য ঘিরেই স্বপ্ন বোনা এক চিলতে ঘরে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
যেমন দরদ দিয়ে শাড়িতে জড়ি বসান দিনরাত, তেমনই ভাবে বুনে চলেছেন স্বপ্ন। মেয়ে একদিন বড় হবে। তাকে ঠিক মতো মানুষ করে জবাব দেবেন বঞ্চনার। হুগলির মশাটের বনমালীপুরের কেয়া পাত্র তাই মাধ্যমিকে ভাল ফল করায়, তার চেয়েও বেশি খুশি তার মা চায়নাদেবী।
সেই ছোট বেলাতেই কেয়াদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তার বাবা। সেই থেকেই নিজে লড়াই করছেন, মেয়েকেও কখনও লড়াই থেকে সরে যেতে দেন না চায়নাদেবী। মেয়েকে বুঝিয়েছেন, যত কষ্টই হোক, পড়া ছাড়া যাবে না। তাই পড়াশোনার মাঝে ফুরসত পেলেই মায়ের সঙ্গে শাড়িতে জড়ি বসানোর কাজে হাত লাগায় সে-ও। শিয়াখালা বেণীমাধব উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে ৫৬২ নম্বর পেয়েছে সে। প্রিয় বিষয় অঙ্কে সে পেয়েছে ৯৬। কিন্তু সারাদিন কাজ করে মা-মেয়ের রোজগার মেরেকেটে ৩০-৩৫ টাকা। তাই এরপর পড়াশোনা চলবে কী করে? সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই মা-মেয়ের। কেয়া বলে “এত দিন স্কুলের শিক্ষকেরা নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। দুই গৃহশিক্ষক বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। কিন্তু এ বার এত খরচ কে দেবে? কার কাছে হাত পাতব?” |
|
|
কেয়া পাত্র |
সন্তু ধাড়া |
|
এমনই অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও উলুবেড়িয়ার দিপালী ধাড়াও তাঁর ছেলে সন্তুকে বলেছেন, কষ্ট সহ্য করেই পড়াশোনা করে যেতে হবে। সন্তুর বাবা ট্রেনে ডাব ফেরি করেন। মা আয়ার কাজ করেন উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে। সন্তু চায় ডাক্তার হতে। মাধ্যমিকে সে পেয়েছে ৬১২। পরবর্তী লক্ষ্য জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষায় সাফল্য। চিকিৎসক হয়ে গ্রামে-গঞ্জে অভাবী, অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে। দিপালীদেবী বলেন, “আমি চাই ছেলে যতদূর খুশি পড়ুক। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব।”
বর্ধমানের ৩ নম্বর ভবানীঠাকুর লেনের নীতীশ পাশোয়ানও পাশে পেয়েছে তার নিরক্ষর বাবা-মা’কে। ভোরে ঘুম থেকে উঠলে পাশের বাড়ির ছাদে বোরহাট রামকৃষ্ণ স্কুলের ওই ছাত্রকে দুলে-দুলে পড়তে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তার প্রতিবেশীরা। বর্ধমান শহরের ৩ নম্বর ভবানীঠাকুর লেনের বাসিন্দারা। মাধ্যমিকে ৬২০ পেয়েছে সে। বাবা বিজয় পাশোয়ান খৈনি বিক্রি করেন সংসার চালান। দৈনিক আয় মেরেকেটে ৫০ টাকা। তাঁদের আদি বাড়ি বিহারে। ভবানীঠাকুর লেনে একটি মাত্র ঘরে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংসার তাঁর। সেখানেই রান্না-খাওয়া, সেখানেই শোওয়া। আলো-বাতাস বিশেষ ঢোকে না। কিন্তু সেখানে পড়াশোনা করা প্রায় অসম্ভব। তাই ভোর হতেই বইপত্র নিয়ে ছাদে চলে যেত নীতীশ। তার কথায়, “গ্রীষ্মে রোদ উঠলে ছাদে থাকা যায় না। তবে শীতের সময়ে অনেকক্ষণ ধরে পড়াশোনা করেছি।” নীতিশ আঁকতে ভালবাসে। তার বাবা-মা নিজেরা নিরক্ষর হলেও সব সময় খেয়াল রাখেন, ছেলে যেন শুধু পড়াশোনাতেই নয়, আঁকার সময়ও নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারে। ভোরের দিকেই যতটা সম্ভব পড়ে নেয় |
|
|
সৌম্যদীপ রায় |
নীতীশ পাসোয়ান |
|
সৌম্যদীপ রায়ও। সৌম্যদীপের পাশে দাঁড়িয়েছেন পাড়াতুতো দাদা দীনবন্ধু মিশ্র। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বাড়ি থেকে দীনবন্ধুবাবুই সৌম্যদীপকে তাঁর নিজের কর্মস্থল খণ্ডঘোষের গৈতানপুরে নিয়ে এসেছেন। সৌম্যদীপের বাবা মা দিনমজুর। দীনবন্ধুবাবুও তাই। কিন্তু সৌম্যদীপের দায়িত্ব নিয়েছেন পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ দেখেই। দীনবন্ধুবাবুর উদ্যোগেই বর্ধমানের কাঞ্চননগর দীননাথ দাস উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সৌম্যদীপ। এ বার মাধ্যমিকে ৬৩৫ পেয়েছে সে। দীনবন্ধুর সঙ্গেই খড়ের চালের ঘরে থাকে সৌম্যদীপ। বিদ্যুৎ নেই। সৌম্যদীপের আক্ষেপ, “ভোরের দিকে যতটা সম্ভব পড়ে নিতে হয়। বেশিক্ষণ পড়তে পারলে হয়তো আরও একটু ভাল ফল হত।” বড় হয়ে ডাক্তারি পাশ করে গরিব মানুষের চিকিৎসা করাই তার লক্ষ্য।
|
প্রতিবেদন: প্রকাশ পাল, হিল্টন ঘোষ, রানা সেনগুপ্ত।
ছবি: উদিত সিংহ |
|
|
|
|
|