পুরোপুরি ‘ঘটনাবিহীন’ থাকল না রাজ্যে ছ’টি পুরসভার ভোট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় এর আগে একটি লোকসভা বা দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন ‘ঘটনাবিহীন’ ছিল। সেই অর্থে ‘প্রশাসক’ মমতার জমানায় রবিবারের পুরভোটেই প্রথম বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটল।
এ বারের পুরভোটে ‘ব্যাপক সন্ত্রাস’ হতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করে আসছিল প্রধান বিরোধী দল
|
দুর্গাপুরে জখম ব্যক্তি। |
সিপিএম এবং সরকারে তৃণমূলের শরিক কংগ্রেস। ততটা না ঘটলেও মারামারি-ভাঙচুর এড়ানো যায়নি এ দিন। দুর্গাপুরের ২৯টি বুথে সিপিএম এবং ১৩টি বুথে কংগ্রেস পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন রবিবার রাত পর্যন্ত কোথাও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেয়নি। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের বক্তব্য, ছ’টি পুরসভার কোথাও বড় কোনও গোলমাল বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি ঠিকই। কিন্তু এই ভোট থেকে যা ‘ইঙ্গিত’ মিলেছে, তার ভিত্তিতে আগামী পঞ্চায়েত ভোটে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে প্রশাসনকে। বিশেষত, সেই ভোট যখন হবে গ্রামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
ছ’টি পুরসভার মধ্যে দুই শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর এবং হলদিয়াতেই মূলত মারামারির ঘটনা ঘটে। দুর্গাপুরে সকাল থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে গণ্ডগোল পাকানোর অভিযোগ উঠছিল। দুপুরে সিপিএমের একটি ক্যাম্প অফিস ভাঙচুর হয়। বিকেলে ভোট মেটার পরেই ৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের একটি ক্যাম্প অফিসে হামলা হয়। তৃণমূলের এক জনের মাথা ফাটে। হলদিয়ায় আবার হামলার অভিযোগ সিপিআই প্রার্থীর বিরুদ্ধে। নদিয়ার কুর্পাস ক্যাম্পে একটি বুথের কাছে কিছু লোক ভিড় করায় পুলিশ তাড়া করে। পড়ে গিয়ে জখম হন এক প্রতিবন্ধী গ্রামবাসী। বিকালে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব তাপস রায় অবশ্য বলেন, “নির্বিঘ্নেই ভোট হয়েছে। দুর্গাপুরের ২৭ নম্বর এবং হলদিয়ার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া কোথাও বড় গোলমাল হয়নি। ওই দুই ঘটনায় দু’জনকে আটক করা হয়েছে।” কমিশন জানায়, বেশ কিছু জায়গায় পোলিং এজেন্ট বসতে না-দেওয়ার মৌখিক অভিযোগ এসেছিল। তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সিপিএম এবং কংগ্রেস কিছু বুথে পুনর্নির্বাচন দাবি করেছে। যদিও তাপসবাবু বলেন, “আমাদের কাছে কোনও দলের তরফেই পুনর্নির্বাচনের লিখিত আবেদন জমা পড়েনি।”
বামেদের ক্যাম্প অফিস ভেঙে দেওয়া, এজেন্টদের মারধর করে বার করে দেওয়া, ‘বহিরাগত বাইক বাহিনী’র দাপিয়ে বেড়ানোর অভিযোগ করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “ছ’টি পুর-এলাকায় নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যাতে কোনও সমস্যা না-হয়, মানুষ যাতে শান্তিতে বাড়িতে থাকতে পারেন, তার জন্য প্রশাসনের তৎপরতা প্রয়োজন।” ভোটের পরে হলদিয়ায় যে ভাবে সিপিএমের এক নির্বাচনী এজেন্টকে অপহরণ করা হয়েছে, বাইক বাহিনী মানুষকে ‘ভয় দেখাচ্ছে’, সেই সব অভিযোগের ভিত্তিতেই এমন আবেদন বলে জানান বিমানবাবু। মঙ্গলবার ভোট গণনার দিনও প্রশাসনের বাড়তি তৎপরতার আর্জি জানিয়েছেন তিনি। |
পুরভোটে অশান্ত হলদিয়া। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে রামগোপাল চকে পুলিশের সামনেই চলছে বচসা। |
দুর্গাপুর, পাঁশকুড়া, কুপার্সে তৃণমূল ‘ভয় দেখিয়ে এবং বুথ দখল’ করে ভোট করলেও স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কোনও কাজ হয়নি বলে দাবি কংগ্রেসের। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “বিধানসভা ভোট এত শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছিল যে, কারও বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক দলই অভিযোগ করতে পারেনি। কিন্তু মাত্র ছ’টি পুরসভার এই ভোট পুলিশ প্রশাসন ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারায় এমন গোলমাল হল। সিপিএমের কায়দাতেই তৃণমূল গোলমাল করেছে।” নলহাটি পুরসভায় সিপিএমের পুরনো কায়দায় তৃণমূল ‘সন্ত্রাস’ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন কংগ্রেস বিধায়ক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও।
তবে বিরোধী বা শরিকের অভিযোগকে ‘গুরুত্ব’ দেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। কারও অভিযোগের প্রেক্ষিতে ‘পাল্টা মন্তব্য’ করতে চান না বলে জানিয়েও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “ছ’টি পুরসভার প্রতিটিতেই মানুষ নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন।” দুর্গাপুরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ এনেছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। আবার তৃণমূলের অভিযোগ, ভারতী রোডের ধারে তাদের ক্যাম্প অফিসে ভাঙচুর চালায় সিপিএম। তিন জনকে মারধর করা হয়। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি তথা বিধায়ক অপূর্ব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সারা দিন শুনলাম, আমরা সন্ত্রাস করছি। অথচ আমাদেরই ক্যাম্প ভাঙচুর হল, মাথা ফাটল আমাদেরই কর্মীর!” |