শেষ পর্যন্ত একটু ঘুরপথে চুক্তি-চাষ চালু করে কৃষি-ক্ষেত্রে সংস্কারের পথে হাঁটতে চলেছে রাজ্য সরকার। এই লক্ষ্যে কৃষিপণ্য বিপণন আইন সংশোধন করা হবে। তবে রাজ্য সরকার ‘কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং’ বা চুক্তি-চাষ শব্দবন্ধটি রাখতে রাজি নয়। তারা এর নাম দিয়েছে, ‘পার্টনারশিপ ফার্মিং’ বা অংশীদারি-চাষ।
রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতর ইতিমধ্যেই এই আইনের খসড়া তৈরি করে আইন দফতরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আইন দফতরের ছাড়পত্র পাওয়ার পরে তা যাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় জানান, মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদনের পরে এটি মন্ত্রিসভায় পেশ করা হবে। তার পর বিল আকারে পেশ হবে বিধানসভায়। তিনি বলেন, চুক্তি-চাষ কার্যকর করার জন্য কেন্দ্র ২০০৩ সাল থেকে রাজ্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। অনেক রাজ্য চুক্তি-চাষ চালু করে দিয়েছে।
এ রাজ্যে চালু না হওয়ায় কৃষি ও গ্রামীণ পরিকাঠামো খাতে প্রতি বছর কয়েকশো কোটি টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে দ্রুত আইন সংশোধন করে চুক্তি-চাষ চালু করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
অরূপবাবু আরও বলেন, রাজ্য আইন সংশোধন না-করলেও জেলায় জেলায় কিছু সংস্থা চাষিদের সঙ্গে চুক্তি-চাষ করছে। রাজ্য সরকারকে কিছু জানানো হচ্ছে না। তাদের কোনও ভূমিকাও থাকছে না। মন্ত্রী জানান, এই চুক্তি-চাষে কৃষকরা উপকৃত হলেও তাঁদের জন্য সে ভাবে কোনও রক্ষাকবচ নেই। তাই রাজ্য সরকার রক্ষাকবচ রেখে আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে।
কী থাকবে সেই আইনে? অরূপবাবু জানান, কোনও সংস্থা চাষির সঙ্গে জমির মালিকানা নিয়ে চুক্তি করতে পারবে না। এই ধরনের চাষের জন্য প্রতিটি সংস্থাকে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিতে হবে। নিতে হবে পার্টনারশিপ ফার্মিং-এর জন্য লাইসেন্স। চুক্তিপত্র জমা রাখতে হবে সরকারের কাছে। সংস্থা ও চাষির মধ্যে বিরোধ বা বিতর্ক হলে রাজ্য সরকারের কাছে বিচার চাওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। এর জন্য জেলায় জেলায় ট্রাইব্যুনাল তৈরি হবে।
কেন্দ্র তার কৃষিনীতিতে ২০০৩ সাল থেকে সব রাজ্যে চুক্তি-চাষ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। তা রূপায়িত হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতীয় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (নাবার্ড) উপর। এই উদ্দেশ্যে একটি আদর্শ আইনও তৈরি করে কেন্দ্র। সব রাজ্যকে এই আইন অনুসারে নিজস্ব আইন সংশোধন করে নিতে বলা হয়। বেশির ভাগ রাজ্য তা করলেও বামফ্রন্ট সরকার নীতিগত প্রশ্ন তুলে চুক্তি-চাষ কার্যকর করেনি। ফলে ২০০৩ সাল থেকে কেন্দ্রের গ্রামীণ পরিকাঠামো খাতের টাকা থেকে বঞ্চিত হয় পশ্চিমবঙ্গ। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এই টাকায় কৃষি পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো যেত। নতুন সরকার আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়েছে। তবে নাম পাল্টে।
কেন এই নাম বদল? রাজ্য সরকারের যুক্তি, কেন্দ্রের চুক্তি-চাষ আইনে চাষির স্বার্থরক্ষার কথা সে ভাবে বলা নেই। কিন্তু তারা যে ভাবে আইন সংশোধন করছে, তাতে কৃষকের জন্য রক্ষাকবচ থাকছে। যাতে জমির মালিকানা কোনও ভাবেই চুক্তি করা সংস্থার কাছে চলে না যায় সেই ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। সেই কারণেই চুক্তি-চাষের বদলে একে বলা হচ্ছে অংশীদারি-চাষ।
তবে রাজ্য কৃষি দফতরের অফিসারদের মতে, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর ফলে রাজ্যে কৃষিতে লগ্নি বাড়বে। চাষে বৈচিত্র আসবে। অর্থকরী ফসল চাষের জন্য কৃষকরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে লাভবান হবেন। উৎপাদিত ফসল বিক্রির বাজার খুলে যাবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পও গড়ে উঠবে।
চুক্তি-চাষ এবং কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্য নিয়ে আলোচনার জন্য গত ২৮ মে গুয়াহাটিতে একটি বৈঠক ডেকেছিল কেন্দ্র। রাজ্যের অফিসারেরা সেই বৈঠকে জানিয়ে এসেছেন যে, কৃষিপণ্য বিপণন আইন সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় নির্দেশ মেনে কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্য চালু করা হচ্ছে। কৃষি বিপণনমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকার কৃষিপণ্যের অবাধ চলাচলের পক্ষে। তার জন্য জেলায় জেলায় যে সব চেক পোস্ট রয়েছে, তা তুলে দেওয়া হবে। |