অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের গুলিতে রণবীর সেনার মুখ্য সংগঠক ব্রহ্মেশ্বর সিংহের নিধন, এ ধরনের যে কোনও হত্যার মতোই, দুর্ভাগ্যজনক এবং অবাঞ্ছিত, এই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত এবং অপরাধীর সমুচিত শাস্তিবিধানও অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এই ঘটনা আরও এক বার দেখাইয়া দিল, তরবারির জোরে যাহারা বাঁচিতে চায়, প্রায়শই তরবারির আঘাতেই তাহাদের মরিতেও হয়। রণবীর সেনা বিহারের উচ্চবর্ণীয় ভূমিহার জাতের ভূস্বামীদের নিজস্ব ‘মিলিশিয়া’ বা বেসরকারি ফৌজ, রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া যাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল মূলত নিম্নবর্গীয় খেতমজুর ও ভূমিহীন কৃষকদের উপর সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। সশস্ত্র এই বাহিনীর হাতে বিহারের লছমনপুর-বাথে, জাহানাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ, নওয়াদা, মিয়াপুর, বাথানিটোলায় গত শতকের সত্তরের দশক হইতে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত অগণিত দলিত গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়াছে। নারী-শিশু-বৃদ্ধনির্বিশেষে দলিত মহল্লা ভস্মীভূত করার বর্বরতায় গোটা দেশকে স্তম্ভিত করিলেও রণবীর সেনার সংগঠক ব্রহ্মেশ্বর সিংহের কেশাগ্রও কেহ স্পর্শ করিতে পারে নাই। তাই তাঁহার এই হত্যাকাণ্ড, দুর্ভাগ্যজনক হইলেও, ‘অহেতুক’ নয়।
ব্রহ্মেশ্বর সিংহের হত্যার প্রতিবাদে রণবীর সেনার সমর্থকরা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করিয়াছে, সার্কিট হাউস পুড়াইয়াছে। তাহাদের প্রশ্ন, ব্রহ্মেশ্বরকে কেন নিরাপত্তা দেওয়া হয় নাই। অথচ ব্রহ্মেশ্বরের সঙ্গে একই অপরাধে অভিযুক্ত রণবীর সেনার অন্য সদস্যরা অনেকেই মৃত্যুদণ্ডে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত, যাহাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আদালত কিন্তু ব্রহ্মেশ্বর সিংহকে সাজা দেয় নাই তিনি ‘ফেরার’ ছিলেন, এই অজুহাতে, যদিও রায় দানের সময় তিনি অন্য মামলায় অভিযুক্ত হইয়া আরা জেলে বহাল তবিয়তে বন্দি ছিলেন। এই সবই বিহারের সমাজের একটা ঝাঁকিদর্শন। অন্তত গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের অন্তিম লগ্ন অবধি এমনটাই ছিল বিহারে সমাজ-রাজনীতি-প্রশাসন। ভূমিহার ভূস্বামীদের রণবীর সেনার মতোই অন্যান্য উচ্চবর্ণীয় জমিদার-জোতদারদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, লোরিক সেনা ইত্যাদি বাহিনী বিহারের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে দাপাইয়া বেড়াইত। তাহাদের প্রতিদ্বন্দ্বে ছিল ভূমিহীন দলিতদের লইয়া গঠিত নকশালপন্থী লাল ফৌজ। দুই আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত মিলিশিয়ার সংঘর্ষে বিহারে কত যে রক্ত ঝরিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই।
সুলক্ষণ ইহাই যে, বিহার বদলাইয়াছে, বদলাইতেছে। রণবীর সেনার মতো ভূস্বামীদের সশস্ত্র বাহিনী এখন আর বিহারের গ্রাম-সমাজের স্থানাঙ্ক নির্ণয় করে না। উন্নয়নই এখন বিহারের গ্রাম-শহরের একটি বড় প্রকল্প। বিজলি-পানি-সড়ক, নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বজনীন বুনিয়াদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত লইয়া সরকার কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে। বিহার এই লইয়া পর-পর দুই বছর দেশের মধ্যে আর্থিক উন্নয়নে সর্বাধিক দ্রুতিতে অগ্রসরমাণ রাজ্য, যাহার উন্নয়নের হার ১৩ শতাংশেরও বেশি। সত্য, ভূমি-সংস্কারের কাজ এখনও বিহারে কেবল অসমাপ্ত নয়, অনারব্ধও। ভূস্বামী বনাম ভূমিহীন খেতমজুরদের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য ও সামাজিক অন্যায়জনিত ভেদাভেদ ও উত্তেজনাও ফল্গুধারার ন্যায় বহমান। কিন্তু অন্তত উপরিকাঠামোর স্তরে নীতীশ কুমারের দায়বদ্ধ কল্যাণকামী শাসনপ্রণালীর সুফল কিছুটা হইলেও প্রবাহিত। রণবীর সেনা, লোরিক সেনা, লাল সেনার তাণ্ডব অনেক কালই বিহারের সংবাদ-শিরোনাম হইতে নির্বাসিত। রাজ্যে যথার্থ আর্থিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখিতে পারিলে ব্রহ্মেশ্বর সিংহের মৃত্যু এই যুগান্তরের একটি প্রতীক হইয়া থাকিবে। |