রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় যতই নিকটে আসিতেছে, বিষয়টি লইয়া বিবাদ-বিসংবাদ ততই বাড়িতেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্যতম ব্যক্তিটি কে, সেই প্রশ্নটি ক্রমশ গৌণ হইয়া উঠিয়াছে। কৌতূহলের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে রাজনৈতিক নকশা বি জে পি নেতারা তাঁহাদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য কত জন শরিককে পাশে পাইতে পারেন, কংগ্রেস কত জনকে কী শর্তে সপক্ষে আনিতে পারিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থনের সুযোগে কী আদায় করিতে পারিলেন, মুলায়ম কংগ্রেসের পরিত্রাতা হইয়া উঠিবার পরিবর্তে কী দাবি করিবেন, জয়ললিতা ও নবীন পট্টনায়ক পূর্ণ সাংমার রাষ্ট্রপতিত্বের দাবির ঘুঁটি সাজিয়া তৃতীয় কোনও জোটের সূচনা করিতে পারিলেন কি না, এই প্রশ্নগুলিই ক্রমাগত ঠোক্কর খাইয়া ফিরিতেছে। রাজনৈতিক দলনেতাদের ছায়া এতই দীর্ঘ হইয়া উঠিয়াছে যে তাহা রাষ্ট্রপতির আসনটিকেও যেন ম্লান করিয়া ফেলিবার উপক্রম করিয়াছে। যিনি ওই পদে আসীন হইবেন তিনি কে, সেই প্রশ্নের তুলনায় তিনি ‘কাহার লোক’ সেই প্রশ্ন অধিক জরুরি হইয়া উঠিতেছে। ইহার অধিক দুর্ভাগ্য আর কী হইতে পারে?
ষাট বৎসরের গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতায় ইহা প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে যে, প্রশাসন তথা অপর কোনও নৈমিত্তিক কারণের জন্য ভারতে রাষ্ট্রপতি পদটির কোনও প্রয়োজন নাই। ইহার প্রয়োজন অনেকটাই প্রতীক হিসাবে, দেশের মানুষ তাঁহাদের দেশনায়ক রূপে এক কৃতী, গুণী এবং সার্থক মানুষকে দেখিতে চাহে। বিশ্বের নিকট যিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করিলে দেশবাসী গৌরব বোধ করিবে, তিনিই যথার্থ রাষ্ট্রপতি। অতএব এই পদের প্রার্থী হিসাবে যাঁহাকে মনোনীত করা প্রয়োজন তিনি রাজনীতির সহিত ঘনিষ্ঠ হউন আর না-ই হউন, দেশের মানুষের উচ্চাশা, প্রেরণা, কল্যাণচিন্তা তাঁহার মধ্যে প্রতিফলিত হইতে হইবে। সেই চিন্তাটি আজকাল রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। তাঁহারা অতি সঙ্কীর্ণ অর্থে ‘সুবিধা’ খুঁজিতেছেন। যেন পাড়ার ক্লাবের সভাপতির পদের প্রার্থী মনোনয়নের সহিত দেশের রাষ্ট্রপতির নাম প্রস্তাবে কোনও পার্থক্য নাই।
এমন এক দিনে ঘটে নাই। ইতিহাসের দিকে তাকাইলে বোঝা যায়, সর্বজনশ্রদ্ধেয়, মান্যগণ্য ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি করিবার যে ইচ্ছাটি স্বাধীনতা উত্তর প্রথম বৎসরগুলিতে প্রচলিত ছিল, তাহা ক্রমশ দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। রাষ্ট্রপতি পদটি যেন রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে। তৎসত্ত্বেও সুপরিচিত, লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি ভিন্ন রাষ্ট্রপতি পদে কাহাকেও ভাবা হইত না। কিন্তু সম্প্রতি সেই প্রথাও বিবর্জিত। এমন মানুষও রাষ্ট্রপতি হইয়াছেন যাঁহার খ্যাতি-কীর্তি খুঁজিয়া পাওয়া সহজ নহে, যাঁহার সম্পর্কে অধিকাংশ দেশবাসী নিতান্ত অজ্ঞ, কাহারও নিকট কোনও বার্তা লইয়া যিনি আসেন নাই। যাঁহার নির্বাচনে জিতিবার সম্ভাবনা সর্বাধিক, তিনি সর্বাধিক যোগ্য প্রার্থী না-ও হইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে, অযোগ্য ব্যক্তির প্রতি সমর্থন দেশবাসীর নিকট শূন্য পরিহাস বলিয়া মনে হয়। রাষ্ট্রপতি পদটি নেতাদের ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতার বস্তু বলিয়া মনে হইতে থাকে। এই বাতুলতা বন্ধ হউক। রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচন সংবিধানসম্মত হইলেও, ঐকমত্যের দ্বারা শ্রেষ্ঠ প্রার্থীকে বরণ করাই কাম্য। যদি তাহা সম্ভব না হয়, তাহা হইলে মান্যতার দৃষ্টিতে প্রার্থী মনোনয়ন প্রয়োজন। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রমাণের বহু ক্ষেত্র পড়িয়া রহিয়াছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সেই পরিধির বাহিরে রাখাই শ্রেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে আসীন জাতীয় কংগ্রেসকেই এই বিষয়ে পথ দেখাইতে হইবে। |