স্বমহিমায় ফিরছে ভূস্বর্গ। নেমেছে পর্যটকের ঢল। আর তার চাপে এখন
বেহাল শ্রীনগর।
শ্রীনগরে ডাল লেকের পাশের বুলেভার্ড রোড ধরে হাটঁতে হাঁটতে কলকাতার দেবাশিস ভট্টাচার্যের মনে হচ্ছে, এ যেন অষ্টমী রাতের কলেজ-স্কোয়ার। ফোনে বললেন, “পুরীর স্বর্গদ্বারেও বোধ হয় এত ভিড় হয় না। হাঁটতে হাঁটতে কেবলই কানে আসছে, ‘ও মাসিমা’, ‘ও দাদা’ ডাক। কত বাঙালি যে এসেছেন, তার হিসেব নেই।”
ডাল লেকের মারলিন হাউসবোটের মালিক পক্ক কেশের গুলাম নবি জানাচ্ছেন, সাম্প্রতিক অতীতে এত পর্যটক তিনি শ্রীনগরে দেখেননি। কিন্তু, ঠিক কত পর্যটক এখনও পর্যন্ত এখানে এলেন, সে সংক্রান্ত কোনও তথ্য জম্মু-কাশ্মীর সরকারের পর্যটন বিভাগ থেকে মিলছে না। সরকারি সূত্রও স্বীকার করে নিচ্ছে, উপত্যকা শান্ত হয়ে আসায় এ বছরের গরমে প্রচুর পর্যটক ভিড় করছেন কাশ্মীরে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ভিড় করেছেন ডাল লেকের ধারে। যার প্রভাব পড়ছে হোটেলের ঘর ভাড়ায়, জিনিসপত্রের দামে। দেবাশিসবাবু জানালেন, ১২ টাকার খাবার জলের বোতল কিনতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়।
কলকাতা থেকে পর্যটকদের নিয়ে শ্রীনগরে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রীরামপুরের ট্যুর অপারেটার কাবুল মুখোপাধ্যায়। কলকাতা থেকেই ৯০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে হোটেলের ‘ভাল’ ঘর বুক করেছিলেন। কিন্তু, সেখানে পৌঁছে দেখেন, সেই ঘরে ইতিমধ্যেই পর্যটক ঢুকে বসে রয়েছেন। তুলনায় খারাপ ঘরগুলি রাখা হয়েছে তাঁদের জন্য। কলকাতার পর্যটকেরা রেগে আগুন। বেজনাথ গুপ্তের অবস্থা আরও করুণ। বেচারা কাউকে দোষও দিতে পারছেন না। গুজরাত থেকে স্ত্রীকে নিয়ে ট্যুরিস্ট বাসে চেপে বসেছিলেন। ভেবেছিলেন, শ্রীনগর পৌঁছে ঠিকই একটা ঘর মিলে যাবে। কিন্তু, কোথায় ঘর? চার দিন ধরে স্ত্রী-কে নিয়ে ট্যুরিস্ট বাসেই রাত কাটাচ্ছেন! তাঁর কথায়, “বাসের লোকেরা না ফিরলে ফিরতেও পারছি না। এ ভাবে থাকতেও আর ভাল লাগছে না।”
বিনয় পেলগাঁওকর কিন্তু দিল্লি থেকেই হোটেল বুক করে এসেছিলেন। শ্রীনগরে এসে জেনেছেন, তাঁর নাম ‘ওয়েটিং লিস্ট’-এ চলে গিয়েছে। দু’চারটি তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে বুকিংয়ের অগ্রিম টাকা পত্রপাঠ ফেরত দিয়েছেন হোটেল ম্যানেজার। তার পরে আর তর্ক চলতে পারে না। বিনয়ের কথায়, “কিন্তু, সেই টাকা নিয়ে অন্য কোথাও হোটেল খুঁজে পাইনি। বহু লোকের মতো আমাকেও গাড়িতেই রাত কাটাতে হয়েছে।”
চুটিয়ে ব্যবসা করছেন ডাল লেক ও নাগিন লেকের হাউসবোট মালিকরা। শ্রীনগর হাউসবোট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজিম তুমান জানালেন, অন্য বার গ্রাহকদের নজর টানার আশায় তাঁরা ঘর সাজিয়ে বসে থাকতেন। তার পরেও মরসুমের একটা বড় সময়ে ফাঁকাই যায় বোট। জলের দর হেঁকেও গ্রাহক মেলে না। এ বার অধিকাংশ হাউসবোটই পুরো রেটে অগ্রিম বুকিং পেয়ে গিয়েছে। তুমান বললেন, “অন্তত দু’যুগ পরে পর্যটকের এই ঢল। আমরা খুশি। কাশ্মীর তার আগের মেজাজে ফিরছে।”
এই পর্যটকদের ঢলে অবশ্য কপাল ফিরেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। অনেকেই বাড়ির একটা-দু’টো ঘর সাফ-সুতরো করে ভাড়া দিতে শুরু করেছেন। পরিবার নিয়ে কোথাও জায়গা না-পেয়ে পর্যটকদের অনেকেই মোটা ভাড়াতে থাকছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিক হেসে বলেন, “মওকা পেয়ে অনেকেই মোটা দাঁও মারছে।” স্থানীয় পর্যটন দফতরের এক কর্তার কথায়, “আমরা পর্যটকদের থাকার পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারছি না। তাই, স্থানীয়দের বাড়িতে রাখা নিয়েও আপত্তি করতে পারছি না।”
পর্যটকদের জন্য রাস্তা-ঘাটে, যত্রতত্র শৌচালয় গড়ে দিতে রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেছেন স্থানীয় ট্যুর অপারেটাররাও। এমনই এক অপারেটার মুমতাজ আহমেদ দার বলেন, “যাঁরা হোটেলের ঘর পাননি, তাঁরা অন্তত হাত-মুখ ধুতে পারবেন। মহিলারা শৌচালয় ব্যবহার করতে পারবেন।” |