রবিবাসরীয় গল্প
চুমু
মাদের অফিসে সীমাকে নিয়ে গুঞ্জনের শেষ ছিল না। আমার সীমাকে খুব একটা চেনার কথা নয়। কারণ, ও কাজ করে একতলায়। ক্যাশে। আর আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। সাদাসাপটা কথায় বলতে গেলে, ও কেরানি আর আমি ম্যানেজারিয়াল পদে আছি। কিন্তু সীমার সম্পর্কে অনেক কথাই সেই একতলা থেকে এসে আমাদের তিন তলায় পৌঁছয়, কেরানিদের গণ্ডি পেরিয়ে। যেখানে সীমার ‘গল্প’-এর শুরু, সেখানে স্টাফদের ‘এমনি’ চেয়ার আর ম্যানেজারদের ‘ঘোরানো’ চেয়ারের দূরত্ব ঘুচে যায়।
এখন আমি এই ম্যানেজারিয়াল পদে এসেছি। এই পদের নিচুতলা থেকেই আমার কাজ শুরু, তার পর ধাপে ধাপে ওঠা। যখন প্রথম চাকরি পাই দাদা বারেবারে সাবধান করে দিয়েছিল, ‘কারও সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করবি না। অফিসের ঘটনা নিয়ে কখনও মুখ খুলবি না। চুপচাপ থাকবি। নিজের কাজ মন দিয়ে করবি। মনে রাখবি মেয়েদের সম্পর্কে গসিপ পেলে অফিসের ছেলেরা মন দিয়ে তার চর্চা করে। আমি এক জন পুরুষ হয়েও এ কথাটা বলছি। অনেক দিন হল তো চাকরিতে। এমনকী কোনও কোনও মেয়েও তাতে যোগ দেয়। পিছনে হাসি-ঠাট্টা করে। ও সব নারীস্বাধীনতা-টাধীনতা কাগজে, ম্যাগাজিনে পড়তে ভাল।’
দাদা আমার কাছে যতটা না দাদা, তার থেকে অনেক বেশি বন্ধু। যে কোনও সমস্যায় আমি দাদার পরামর্শ নিয়ে চলি। অফিসে এসে প্রথমে তার হালচাল বোঝার চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে আমার ডিপার্টমেন্টের সবার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। এক ঘণ্টার লাঞ্চ আওয়ারে আমরা একজিকিউটিভ ক্যাফেটারিয়ায় খাই। লাঞ্চ মানে প্রায় একই মেনু। ভেজিটেবল স্যুপ, চিকেন স্যান্ডউইচ, একটা মাফিন বা ব্রাউনি। মাঝেসাঝে একটু এধার-ওধার। যারা আমাদের থেকে নীচে কাজ করে তাদের ক্যান্টিনে ডাল, ভাত, ভাজা বা তরকারি, মাছের ঝোল বা ঝাল কিংবা ডিমের ডালনা, এক এক দিন আবার চিকেন কারিও পাওয়া যায়। সবই সাবসিডাইজড রেট। আমাদের সাহেবি লাঞ্চ কত দিন আর মুখে রোচে! তখন তাদের ক্যান্টিনের খাবার আনিয়ে খাই। ওই ক্যান্টিনটাকে সবাই বলে কচিদার ক্যান্টিন। ক্যান্টিনের খাবার ক্যাফেটারিয়ায় বসে খেলে ক্যান্টিনের ইজ্জত বাড়ে আর ক্যাফেটারিয়ার মর্যাদা কমে। স্লট মেশিনের চা-কফি খাওয়ার জন্যে টি-কর্নার আছে। সেখানে কেরানি-ম্যানেজারে সবার জন্যেই সমান ব্যবস্থা।
লাঞ্চে এক ঘণ্টা সময় যথেষ্ট। তখন শুরু হয় গসিপ। বেশ জমিয়ে। একটা রসালো গল্পের আস্বাদ পেলেই হল। তা একেবারে দুর্নিবার গতিতে অফিসের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। আমি শুনি। আর মনে মনে বলি, উফ, দাদা যে কী ভাল পরামর্শটাই না দিয়েছিল ‘কান-চোখ খোলা, মুখ বন্ধ।’
‘আমাদের কোম্পানিতে ফর্মাল পোশাকের চল। সে মেয়ে মাঝে মাঝে জিনস-টি-শার্ট পরে চলে আসে।’
‘ওই যে স্টোরে নতুন মেয়েটা এসেছে না, কী যেন নাম। হ্যাঁ। সীমা, সীমা। কেমন ছেলেদের মতো খাড়া খাড়া করে চুল কাটা। ছোট চুল তো আজকাল অনেক মেয়েই রাখে। এই তো আমাদের চিত্রিতারও ছোট চুল। ও কী সুন্দর করে কাটে। বেশ ভাল লাগে। চুল কাটবি বলে ছেলেদের মতো ছাঁট দিবি?’
আমি নিজের ছোট চুলে এক বার হাত বুলিয়ে নিলাম। সামনের বেশ কয়েক গাছা চুল লম্বা করে কাটা। সেই লম্বা গাছাটাকে আমি কানের পিছন দিয়ে এনে লতি পর্যন্ত টেনে ঘুরিয়ে জুলপির সামনে গুছিয়ে রাখি। সেই গুছি ক’টা আমার গাল ছুঁয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই আমি সেই গুছিগুলোকে বিন্যস্ত করি। আমার চুলের পিছন দিকটা ওয়েজ কাট, ঠিক তার ওপরটা আবার গোল করে কাটা। আমার চুল ঘন বলে আমি পিছনের চুল ও-ভাবে ওয়েজ করে আবার রাউন্ড শেপে কাটতে পারি। আমার চুলের কাটিং ওদের পছন্দ হয়েছে বলে আমার কোনও অতিরিক্ত আনন্দ নেই। সীমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে সে চুল কাটবে।
‘শুনি ওর খুব রাজনীতিতে আগ্রহ। কলেজে থাকতে কোনও একটা লেফটিস্ট দলের হয়ে কাজ করত। এখন আর সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করে না। তবে নিজের টাকা খরচ করে এখনও ও বিভিন্ন ইস্যুতে নিজের মতামত দিয়ে লিফলেট ছাপে। প্রথম বার একতলায় অনেক স্টাফের মধ্যে বিলিও করেছিল। ওকে ডেকে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, এটা কাজের জায়গা। এখানে লিফলেট বিলি করা, রাজনীতি করা চলবে না। কী সাহস মেয়েটার বুঝুন। সবে নতুন চাকরিতে এসেছে! প্রথম বারই কড়া ভাবে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে এ রকম করলে অফিস স্টেপ নিতে বাধ্য হবে।’

আমি ওর চুলের স্টাইল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করাটাকে সমর্থন না করলেও লিফলেট বিলি করাটা যে সীমার করা উচিত হয়নি, তা একশো বার মানি। সে দিনের মতো সীমাকে নিয়ে আলোচনার ছেদ পড়ল ওখানেই। লাঞ্চ আওয়ার শেষ। এই নতুন স্টাফটি কে, জানার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল। কেমন তার চেহারা? সীমাকে দেখব বলে তো আর ক্যাফেটারিয়া ছেড়ে ক্যান্টিনে যাওয়া যায় না! একটা সুযোগ খুঁজছিলাম। আমি হিউম্যান রিসোর্সে আছি। এম বি এ পড়ার সময়ে এটাই ছিল আমার স্পেশালাইজেশন। সীমার দরখাস্ত দেখে আমি আরও কয়েক জনের সঙ্গে ওকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে আসার সুপারিশ করি। কিন্তু যখন ওদের ইন্টারভিউ হয়, তখন আমি ছুটিতে ছিলাম। নতুন স্টাফদের কাজের রিভিউ হচ্ছে। ওর সম্পর্কে রিপোর্ট ভালই। এখনও পর্যন্ত ক্যাশের মতো একটা দফতর ও বেশ সামলিয়ে চলছে। বিশ্বাসও অর্জন করেছে। তবে কতটা বিশ্বাস করা যায়, তার পরীক্ষা এখনও অনেক বাকি। বেশি দিন তো চাকরি করছে না।
হঠাৎই ওকে ডেকে পাঠানোর সুযোগ এসে গেল। আমি পি বি এক্স-এ বললাম, ‘সীমা লাহিড়িকে বলুন আমার সঙ্গে দেখা করতে।’
একটু বাদে আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল ‘কাম ইন।’
আমি সীমা ঢুকবে জেনেও চেয়ার ঘুরিয়ে পিছনের ক্যাবিনেট থেকে কিছু একটা খোঁজার ভান করছিলাম। মেয়েটি দরজা খুলে ঢুকল তা বুঝেও আমি চেয়ার ঘোরালাম না। সেই ভঙ্গিতেই বললাম, ‘বসুন’। এ বার বোঁ করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিলাম আমি ওপরতলার মানুষ। তাকে দেখেই কিন্তু আমি চমকে গেলাম। অবিকল গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তীর মতো চুল ছোট করে কাটা। সেই সেন্ট জনস ডায়েসেশনে পড়া মেয়েটির মেধা আজও বিশ্বজোড়া। এই সীমাও কি গায়ত্রীর মতো ফেমিনিজমে বিশ্বাস করে? অবশ্য গায়ত্রী নিজেকে শুধু ওইটুকু বলেন না। তিনি নিজেকে বলেন, ‘প্র্যাক্টিকাল-মার্কসিস্ট-ফেমিনিস্ট-ডিকনস্ট্রাকশানিস্ট’। সীমার পাশাপাশি গায়ত্রী স্পিভাকের নাম উঠে পড়লে তা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।
মেয়েটার মধ্যে একটা টমবয়িশ ভাব আছে। শাড়ি পরলেও তার অগোছালো ভাব দেখে বোঝা যায় সে এখনও এতে অভ্যস্ত হয়নি। আমি দেখলাম আমার সামনের চেয়ারে যে বসে আছে সে স্বাস্থ্যবতী। লম্বা হাতা ব্লাউজের মধ্যে দিয়ে তার হাতের সুডৌল ফুটে উঠেছে। চার চৌকো কালো ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে তাকে ব্যক্তিত্বময়ী লাগে। বুকের কাছে এসে তার শাড়ি অবাধ্য হয়ে উঠেছে। সে সেফটিপিন লাগিয়েও তাকে বশে আনতে পারেনি। ঢাকা পড়েনি তার উন্নত বুক। তার হাত-মুখ পিছল, মসৃণ। সে ফর্সা নয়। কিন্তু তাকে ঘিরে আছে লাবণ্য। তার মুখে-চোখে দেখিনি ছিটেফোঁটা পাউডারের প্রলেপ বা কাজল-লিপস্টিকের আলতো ছোঁয়া। এমনকী সে একটি বিন্দু ছোট টিপও বসায়নি তার কপালে। যে মেয়ের গায়ত্রী স্পিভাকের মতো চুল, সে বিন্দু টিপই বা বসাবে কেন? বুঝলাম তাকে ঘিরে এত কথা কেন। তার মাড় দেওয়া সুতির ছাপা শাড়ি থেকে মাঝেমাঝে খসখস শব্দ হচ্ছে। সে পিঠ সোজা করে বসে আছে। হাত ফেলা কোলের ওপর। আমার চোখের ওপর চোখ রেখেছে। তার ঋজু বসার ভঙ্গি, আমার চোখের ওপর তার চোখ পেতে রাখা, এর মধ্যে আমি এক জন দৃঢ় মেয়েকে দেখতে পেলাম। আমি যে তার থেকে অনেক উঁচু পদে কাজ করি, সে জন্যে তার মধ্যে কোনও অতিরিক্ত সম্ভ্রম নেই। আবার সে ফেলে আসেনি কোনও স্বাভাবিক সৌজন্য।
‘আপনি যখন কাজে জয়েন করেন, তখন আমি ছুটিতে ছিলাম। আপনার মার্কশিটের অ্যাটেস্টেড কপি জমা দেবেন।’
‘আমাকে একটু সময় দেবেন? কারণ, আমার চেনা কোনও গেজেটেড অফিসার নেই। চেনা কারও কাছ থেকে জেনে অ্যাটেস্ট করাতে হবে। দিন চার-পাঁচের মধ্যেই করিয়ে ফেলতে পারব।’
‘ওকে। কেমন লাগছে নতুন কাজ পেয়ে?’
‘টাকার দরকার তাই করছি। আমার যোগ্যতায় যা পেয়েছি, সেটাই সততার সঙ্গে করার চেষ্টা করছি।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
‘আমি কি তা হলে যাব?’
‘ওকে। ইয়া।’
সীমা আমাকে ম্যাম বলল না এক বারও। অথচ কোম্পানির এইচ আর-এ যারা থাকে, তারা বাড়তি সম্ভ্রম পেয়ে থাকে। কারণ, কর্মীদের সব ফাইল থাকে তাদের কাছেই। অথচ আমার সীমার ওপর একটুও রাগ হল না।
পরের দিন শুনলাম, ‘চিত্রিতা, তুমি নাকি সীমাকে তোমার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলে?’
‘এ খবরও তোমাদের কানে পৌঁছয়?’
‘ওই তো এখন আমাদের হিরোইন। তাকে তোমার বদলে আমাদের ডাকার কথা।’ এই বলে রঞ্জন খ্যাক-খ্যাক করে হাসল। যেন কী দারুণ একটা রসিকতা করা হল!
‘আমার ওর মার্কশিট দরকার, তাই ডেকে পাঠিয়েছিলাম।’
বলেই বুঝলাম ভুল করেছি। আমি কেন কাকে ডেকে পাঠাব, সেটা আমার বস ছাড়া আর কারও তা জানার কথা নয়, আমারও জানানো উচিত হয়নি।
‘ও টি-কর্নারে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। দেখলাম বেশ অভ্যস্ত হাতে দেশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাল।’
‘সিগারেট কী বলছ! ও তো বিড়িও খায়। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে অফিস করে। তার মধ্যে বোধ হয় বইপত্তর থাকে। সেই এক সময়ে কলেজ স্ট্রিটে কফি-হাউস-মার্কা এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল থাকত না, অনেকটা তাদের মতো।’
‘আমাদের এই অফিসে বিড়ি! আই টি সেক্টরে! ও-ই বোধ হয় এটা চালু করল!’
সীমার সূত্রে অফিসে অনেকেরই চা-তেষ্টা, কফি-তেষ্টা বেড়ে গেল। আমাদের টি-কর্নারে চা-কফির জন্যে দু’জন লোক। তারা টাকা নেয়, সার্ভ করে। সেই কোম্পানির বাড়বাড়ন্ত হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাজের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে নোটিস টাঙিয়ে দিলাম।
‘চা বা কফি খান। কিন্তু তার জন্যে অতিরিক্ত সময় খরচ করবেন না। দেখা গেছে একই ডিপার্টমেন্টের একাধিক লোক একই সময়ে চা খেতে যাচ্ছেন। সেই সময়ে ওই বিভাগের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভে আমাদের অফিস। সন্ধেবেলা যখন বাড়ি ফিরি, তখন পথের বাতি জ্বলে যায়। সেক্টর ফাইভের বহু বেসরকারি অফিস থেকে ডোনেশন নিয়ে সেক্টর ফাইভে অনেক পুতুল পুতুল মূর্তি বসানো হয়েছে। কোথাও একটা বড় শাঁখ দিয়ে রাস্তার দু ’ধার সাজানো, কোথাও বা কৃত্রিম টিলা। আমাদের অফিস থেকেও ডোনেশন গিয়েছে। ফেরার সময়ে গাড়িতে আসতে আসতে কত কথাই ভাবি। বিয়ের মরশুমে নিকো পার্ক, নলবনে বিলাসবহুল ম্যারাপ বাঁধা হয়। যে দিন জ্যোৎস্নায় চার ধার ভেসে যায়, সে দিন ওই রাস্তা দিয়ে এলে বড় বিভ্রম হয়। তবে কি চাঁদের আলোর থেকেও জোরদার বড়লোকদের বিয়েবাড়ির আলো! যে দিন আরও একটু বেশি রাত হয়, সে দিন বাজির থেকে তৈরি হয় আলোর মালা, ফুল। সে সব চার দিকে ছড়িয়ে যায়। সে দিনও ঘোর লেগে যায়। এক রাতে লাখ টাকার বাজি পুড়ল। সে দিন সামনের চরাচর জ্যোৎস্না। আই টি সেক্টরের ভিড় ভুলে যাই। চিংড়িঘাটা অবধিই তো ভিড়। তার পর ট্র্যাফিক সিগনাল ছাড়া হুহু করে গাড়ি যায়। কাচের মধ্যে দিয়ে দেখি গাছের ভিড়। অফিস ভুলে যাই। সে দিন ঘরে ফেরাটা ভারী সুন্দর হয়।
মনেই পড়ে না দু’এক দিন আগে বিমান মিত্র ইন্টারকমে বললেন, ‘ম্যাডাম, একটু আসব নাকি?’
‘আসুন’ বলেই সিঁটিয়ে যাই। অতি ভদ্রতার এক দোষ। মুখের ওপর কাউকে ‘না’ বলা যায় না। উনি টাইয়ের নটটা একটু ঠিক করে নিতে নিতে বললেন, ‘বসি তা হলে।’ আমি কিছু বলার আগেই উনি চেয়ার টেনে বসে পড়েছেন।
‘শুনুন আর এক কীর্তি...’
‘নিশ্চয়ই সীমার সম্পর্কে কিছু বলবেন?’ আমার কোনও কথার তোয়াক্কা না করে বলতে শুরু করলেন, ‘আরে কাণ্ড শুনুন। সীমা গত কাল অফিসে সদর্পে সবার সামনে বলেছে ওর দুটো বিয়ে। দু’পক্ষের দুই সন্তান। বাড়িতে জায়গা কম। প্রথম পক্ষের মেয়ের পড়াশোনার অসুবিধে হচ্ছে, তাই তাকে দু’তিনটে বাড়ি পরে একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছে। সীমা রোজ তার খোঁজ নেয়। কিন্তু সে আলাদা থাকে, আলাদা খায়। আর এখনকার স্বামী এক ঘরে শোয় আর সীমা এক চিলতে জায়গায় একটা ছোট খাট পেতে শোয়। কী বুঝলেন?
রহস্যে ভরা হাসি হেসে বিমান মিত্র ভুরুটা একটু তুললেন। ভাবলেন আমি বোধ হয় নতুন খবরটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। বললাম, ‘ছাড়ুন না, যে যা করছে করতে দিন। আপনার তো কোনও লাভ-ক্ষতি হচ্ছে না।’
পরের দিন আমার একটা নেমন্তন্ন ছিল অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়েছি। বাসস্টপে দেখি সীমা দাঁড়িয়ে। না দেখার ভান করেই সবাই চলে যায়। আমি দাঁড়ালাম। এর আগেও আমি ওকে লিফ্ট দিয়েছি। অনেক দিনই হল আমি ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছি। ও গড়িয়ায় থাকে। আমার সঙ্গে রানিকুঠি পর্যন্ত চলে যেতে পারে। তার পর অটো। সে-দিন আমরা নীরবে পথ চলছিলাম। যেন দু’জনে দুটো দ্বীপের বাসিন্দা। নীরবতা ভাঙলাম আমিই।
‘কী ব্যাপার তুমি এত গম্ভীর। আজ কোনও কথা বলছ না তো। এ গাড়িটা তো অফিস নয়।’ আমি ওকে সহজ হওয়ার সুযোগ দিলাম। ওর চোখের কোণে কি একটু জলের রেখা দেখলাম? এটা ওর চরিত্র নয়।
‘আমাদের পাড়ায় সুমিতা বলে আমার এক বন্ধু ছিল। তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার দাদা তাকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। ও অনেক দিন পেয়িং গেস্ট হিসেবে একটা জায়গায় ছিল। একটা সাধারণ চাকরি করত। তার থেকে টাকা জমিয়ে ও একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনেছিল। ফ্ল্যাটের লোন শোধ করবে বলে ওর দাদার বাড়ির ওখানে থাকত এমন এক জন ছেলেকে ও পেয়িং গেস্ট হিসেবে রাখত। বহু দিনের পরিচিত। ছেলেটা ওর থেকে অনেক ছোট। কলেজে পড়ে। ওর সঙ্গে সত্যিই দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল। পরীক্ষার আগে পড়াশোনা না করলে বকত। আবার নিজে যেটুকু মাইনে পেত তার থেকে ওর জন্যে হরলিকস কিনে আনত। সেই নিয়ে সুমিতা আর ওই ছেলেটিকে জড়িয়ে তার অফিসে কত যে খারাপ খারাপ কথা বলা হত, তা শুনলে আপনি কানে আঙুল দেবেন। আমার ভাই কাল পাড়ার ক্লাবে টেবিলটেনিস খেলতে গিয়েছিল। সুমিতা আট মাস আগে মারা গিয়েছে। ওর মৃগী ছিল। রাতে খাট থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পায়। ইন্টারনাল হেমারেজে মারা যায়। আমার ভাই বলল, এখনও সেই মৃত সুমিতাকে নিয়ে পাড়ার ছেলেরা হাসি-ঠাট্টা করে। মরে গিয়েও সে কলঙ্ক মুছতে পারল না। আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। সুমিতার সঙ্গে ছেলেটার দিদি-ভাই ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটাকে কি আমরা কীটপতঙ্গের হাতে ছেড়ে দেব?’
আমি ম্যানেজার, আমার অধস্তন কর্মীর কাছ থেকে এতগুলো কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমার কর্পোরেট দুনিয়ার নকল অহংকার আর গাম্ভীর্যের রাংতা ঝেড়ে ফেলে ওকে বললাম, ‘তুমি খুব ভাল মেয়ে।’
ও বোধ হয় কোনও দিনও ভাবেনি আমি ওকে এমন কথা বলতে পারি।
সে দিন রাতে ডিনার করে ঘরের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। মনটা খারাপ লাগছিল। ছাদে বিশেষ যাই না। সে রাতে গেলাম। হেমন্তের হিম পড়ছে। হা হা বাতাস বইছে দেখে মাথায় ওড়নাটা পেঁচিয়ে নিলাম। আবেগ আর কান্নার সঙ্গে আড়ি করা কর্পোরেট জগৎ থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারব তো? না হলে কে বাঁচাবে সুমিতাদের। আমরা সুখে থাকতে থাকতে ভুলে যাই এ জীবন কত দুর্লভ। কত অবহেলায় এই সব দিনগুলো কাটিয়ে দিই। আমাকে নিয়েও কত ফিসফিসানির কথা কানে এসেছে। এক টুসকিতে সে সব ঝেড়ে ফেলেছি। কত বার। বহু বার। আমি নিজের কাছে নিজে সৎ থেকেছি। এ এক পাহাড়প্রমাণ জোর। এই জোর ছড়িয়ে দিতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে। কোনও মই যেন বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
শীত পড়ে গেল। প্রতি বছরই আমাদের শীতকালে একটা পিকনিক হয়। ম্যানেজমেন্ট টাকা দেয়। স্টাফদের অ্যাসোসিয়েশন জায়গা বাছাই করে। কী মেনু হবে, কোন কেটারার রাঁধবে, কোন বাস যাবে এ সব ঠিক করে তারাই। এতে সাধারণ কর্মী, তাঁদের পরিবার থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট স্টাফ, এমনকী কোম্পানির ডিরেক্টর, ম্যানেজিং ডিরেক্টর পর্যন্ত যান। ওঁরা বা আমরা অবশ্য নিজেদের সুবিধে অনুযায়ী যাই নিজেদের গাড়িতে। সেই সাতসকালে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করি না।
ওখানে পৌঁছে দেখি জমে গিয়েছে পিকনিক। অনেকেই জটলা পাকিয়ে হইহুল্লোড় করছে। ছবি তুলছে। কেউ কেউ তাস খেলছে। ছোটরা ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন খেলার সরঞ্জাম নিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বাগানের ফুলের কেয়ারি দেখছে। কোনও গাছে স্বল্পায়ু ঝলমলে ফুলেরা আলগোছে ফুটে আছে। শীতের বাতাসে পুকুরের জল তিরতির করে অল্প কাঁপছে। কোথায় আবার অন্ত্যাক্ষরী হচ্ছে। আর তার মাঝে মাঝেই ঘুরছে চা-কফি আর এটা-ওটা ভাজাভুজি।
হঠাৎ কোথা থেকে এক মুখ রাগ, দু’চোখে আগুন নিয়ে সীমা পিকনিকের জটলা যেখানে সব থেকে বেশি, সেখানে উপস্থিত। পিকনিকের মাধুর্য, মজা সব শুষে নিয়ে সে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এল তমালকে। ও কিছু বলার আগেই ওর দু’চোখের আগুন দেখে সবাই বুঝল, একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছে। সবার সামনে চিৎকার করে সে বলল, ‘কী ভেবেছিস তোরা? আমি তোদের মোবাইল নম্বর জানি না? তুই আর মিলন আমাকে তখন থেকে প্রেমের মধুর মধুর এস এম এস পাঠাচ্ছিস, বাজে কথাও লিখছিস। কিছু করার থাকলে সামনে কর না। আমি প্রস্তুত। তোদের সে সাহস নেই? মিচকে শয়তান।’
এই বলে ও তমালকে একেবারে মাটিতে ফেলে ওর গালে চকাস চকাস করে চুমু খেল। ওখানে তখন এই নাটকের দৃশ্য দেখে সবাই হতভম্ব, কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছে না। ওখানে তখন আমাদের টি-কর্নারের রতন থেকে আরম্ভ করে কেটারিংয়ের লোক, উঁচুতলার কর্মী থেকে নিচুতলার কর্মী সবাই জড়ো হয়ে গিয়েছে। যে কাজ আমি করব বলে ভেবেছিলাম তা সীমা করে দিল। কত সহজে। যেন হেলায় করল জয়। সে দিন সীমার সীমানাহীন সাহস আকাশ ছুঁয়েছিল। ও তমালকে বলল, ‘তোকেই চারটে চুমু খেলাম। দুটো তোর দু’গালে আর বাকি দুটো মিলনের দু’গালে। ওকে দিয়ে দিস।’

ছবি: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.