সে দিনের ক্ষুব্ধ স্বজনেরাই এখন খুশিতে উদ্বেল
দু’বছর আগে এ ভাবেই সে দাঁড়িয়েছিল উঠোনে। বাড়ির সকলে ঘিরে ছিল চারপাশ। এক লাজুক নাবালিকা নিজের জেদে অটল ছিল, বিয়ে করবে না। তার আত্মীয় স্বজনেরা সে দিন চেষ্টা করছিলেন সেই জেদ ভাঙার।
এ বার সেই বাড়ির উঠোনেই তাকে ঘিরে আত্মীয়স্বজনদের উদ্যাপন আর থামেই না। মাধ্যমিকে দু’টো বিষয়ে লেটার নম্বর-সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। কিন্তু ২০১০ সালের মার্চের সেই দমবন্ধ করা সকালটা এখনও ভুলতে পারে না বহরমপুর শ্রীশচন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী বীথিকা দাস। সে দিন কান্নাকাটিতেও বড়দের মন নরম হয়নি। শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদের দিনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে স্কুলে চলে যায়। তার পরে সহপাঠীদের সঙ্গে পরামর্শ করে মুর্শিদাবাদ চাইল্ড লাইনে ফোন করে সাহায্য চায় বীথিকা। বাবা ভানু দাসের চপের দোকান। তিনি বলেন, “অভাবের সংসার বলেই নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তবে ঠিক সময়ে বিয়েতে অমত করায় আজ ওর জন্য গর্ব হচ্ছে। সকাল থেকে দোকানে আমার কাজে সাহায্য করার পরেও নিজের চেষ্টায় ও যে মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে, তার জন্য সমস্ত কৃতিত্ব ওর।”
জয় বাউড়ি অঙ্কিত তিওয়ারি অর্ঘ্য দত্ত খোকনচন্দ্র হাতি বীথিকা দাস রত্না বিশ্বাস
বাড়ির অমতেই পড়া চালিয়ে গিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর ষষ্ঠপল্লি শম্ভুনাথ হাইস্কুলের ছাত্র খোকনচন্দ্র হাতিও। মাধ্যমিকে সে পেয়েছে ৫৯৪। বাবা-মা দিনমজুর। সংসারে অর্থাভাব। সাইকেলের দোকানে কাজ করতে হয়েছে তাকে। এখন খোকনের স্বপ্ন ভাল স্কুলে ছাত্রাবাসে থেকে পড়া। তার বাবা-মা জানেন না, ছেলেকে এর পরে পড়াবেন কী করে। তবে প্রধান শিক্ষক শ্রীমন্ত চৌধুরী বলেন, “বাড়ির চাপে ওর পড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের উপার্জন ও শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি নিজের মেধা ও অদম্য জেদে ওর এই ফল। সুযোগ পেলে ও প্রতিষ্ঠিত হবেই।”
একই ভাবে মাধ্যমিকে ছেলের ভাল ফলের খবর শোনার পর থেকে খুশি হওয়া তো দূর, রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বর্ধমানের মন্তেশ্বরের পুরগুনা গ্রামের দম্পতি কানন ও তনু দত্ত। শক্তিগড়ে একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করে কাননবাবুর মাসে যা উপার্জন, তাতে সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। ছেলে অর্ঘ্য এ বার মাধ্যমিকে ৫৯৮ পেয়েছে। তনুদেবী বলেন, “একে তো টানাটানির সংসার। তার উপরে মেয়ের পড়াশোনার খরচ রয়েছে। এখন ছেলেকে কী ভাবে পড়াব, সে নিয়েই চিন্তায় পড়েছি।”
বাঁকুড়ার বড়জোড়ার মালিয়াড়া গ্রামের অঙ্কিত তিওয়ারিকেও বাবার চায়ের দোকানে সময় দিতে হয়। দোকানে বসেই পড়াশোনা করে মালিয়াড়া রাজনারায়ণ হাইস্কুলের এই ছাত্র এ বার পেয়েছে ৫৬৯ নম্বর। তার মা শুক্লা তিওয়ারির আক্ষেপ, “মাধ্যমিকের এক মাস আগে দুর্ঘটনায় ওর বাবা পাঁজরে চোট পেয়ে শয্যাশায়ী হন। তখন অঙ্কিতরা দুই ভাইকে দোকান সামলে পড়াশোনা করতে হয়েছে।”
নিজের জেদে অটল ছিল পুরুলিয়ার আদ্রার বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠের জয় বাউড়িও। বাবা রিকশাচালক। তার সংসারের অবস্থা দেখে জয়কে ছাত্রাবাসে রেখে স্কুলের গ্রন্থাগার থেকে বই দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলের শিক্ষকেরা। তাঁদের মুখ রক্ষা করেছে পুরুলিয়ার আদ্রার বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠের জয় বাউড়ি। পেয়েছে ৬০৩ নম্বর। শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ এই ছাত্রের ইচ্ছা, “বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই। দুঃস্থ মেধাবীদের পাশে দাঁড়াতে চাই।” স্কুলের প্রধান শিক্ষক নীলোৎপল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “পরিবারের অবস্থার কথা ভেবেই ওকে ছাত্রাবাসে রাখা হয়। স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ও আমাদের গর্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।”
মা আর ভাইয়ের সঙ্গে হুগলির গুপ্তিপাড়ার আয়দা কলোনির রত্না বিশ্বাস মুখ উজ্জ্বল করেছে তার মায়ের। রেল লাইনের ধারে টিনের চালা আর পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা একচিলতে বাড়িতে মাথা গুঁজে থাকে রত্নারা। বাবা সংসার ছেড়ে গিয়েছেন বহু আগেই। মা কমলাদেবী চুঁচুড়ায় ফুটপাথে সব্জি বিক্রি করেন। মেয়ের পড়াশোনার উপরে তাঁর কড়া নজর। রত্না এ বার গুপ্তিপাড়া আয়দা সত্যব্রত বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে ৫০৪ নম্বর পেয়েছে। রত্নার কথায়, “মা কত কষ্ট করে পড়াচ্ছেন, আমিই জানি। এখন চাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। তাতে যত কষ্টই হোক, পিছিয়ে আসব না।”

প্রতিবেদন: শুভাশিস সৈয়দ, অমিত কর মহাপাত্র, কেদারনাথ ভট্টাচার্য,
রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়,শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল ও প্রকাশ পাল।
ছবি: গৌতম প্রামাণিক, কৌশিক মিশ্র, সুজিত মাহাতো



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.