ঋণভারে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গকে ‘স্পেশ্যাল কেস’ হিসাবে চিহ্নিত করে তার জন্য একটি বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার পূর্ণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রের মনমোহন সিংহ সরকার। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সীমাবদ্ধতার মধ্যেই প্রয়োজনীয় ‘ফাঁক’ খুঁজে বার করার চেষ্টা চলছে বলে কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের জন্য অর্থসাহায্য চেয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। পাওয়ামাত্র সেটি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রণববাবু। সূত্রের খবর, গত কাল সাত নম্বর রেসকোর্সে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে প্রণব-মনমোহন আলাদা বৈঠকে বসেন, যার ভিত্তি ছিল নারায়ণনের সেই চিঠি। আলোচনার সময়ে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাও ছিলেন। সরকারি শীর্ষ মহলের দাবি: পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্যাকেজ দিতে দিল্লি যে কতটা আন্তরিক, এই ‘তৎপরতা’ই তার প্রমাণ। কিন্তু কেন্দ্র কী ভাবে, কেমন প্যাকেজ দিতে পারে?
গত কালের বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রের দাবি: পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সঙ্কটের বিষয়টিকে ‘বিশেষ’ তকমা (স্পেশ্যাল কেস) দেওয়ার চেষ্টা হবে। |
যদিও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনও রাজ্যকে পৃথক ভাবে ‘বিশেষ’ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা ব্যাখ্যা করে প্রণববাবুও সম্প্রতি রাজ্যসভায় বলেছেন, “দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ২৮টি রাজ্যের প্রতিই আমার সমান দায়িত্ব। আমি এমন কিছু করতে পারি না, যা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।” তবে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে এই ‘সীমাবদ্ধতার প্রাচীরের’ মধ্যেই একটা কোনও ‘ফাঁক’ বার করার চেষ্টা চলছে। অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষ আমলার কথায়, “কেন্দ্রের সম্ভাব্য যুক্তি হবে, কেরল-পঞ্জাবের ঘাড়ে ঋণের বোঝা থাকলেও তাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা চলে না। পশ্চিমবঙ্গের পুঞ্জীভূত ঋণ বিপুল, সঙ্কটও তীব্রতর।”
এবং এই যুক্তির ভিতের উপরে দাঁড়িয়েই পশ্চিমবঙ্গকে ‘স্পেশ্যাল কেস’ হিসাবে গণ্য করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় সূত্রের ইঙ্গিত। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ও অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর: অনুন্নত এলাকা উন্নয়নে গত বছর যেমন পশ্চিমবঙ্গকে ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্রান্ট ফান্ড’ (বিআরজিএফ) খাতে ৮৭৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, এ বারও সেই খাতে অর্থ বরাদ্দ হবে। পাশাপাশি ‘পাবলিক রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট’ বাবদ এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি) থেকে রাজ্যকে প্রথম দফায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে। এডিবি’র অর্থপুষ্ট প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য, রাজ্যের রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে তা আরও সুচারু রূপে ব্যবহারের উপায় সন্ধান ও তার রূপায়ণ, যাতে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি সার্বিক ভাবে বৃদ্ধির পথ ধরতে পারে।
তবে কেন্দ্র ভাল করে জানে যে, রাজ্যের ঋণে টানা তিন বছর সুদ-আসল মেটানোয় ছাড়ের জন্য ‘মোরাটোরিয়াম’-এর দাবিকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। প্রকল্প-ভিত্তিক বরাদ্দ কিংবা ঋণকে নয়। এ ব্যাপারে দিল্লি কী ভাবছে?
অর্থ মন্ত্রকের আমলাটি বলেন, মূলত ওই দাবি নিয়েই এখন খুঁটিনাটি অঙ্ক কষা চলছে। কেন্দ্র এ-ও বিলক্ষণ জানে, ‘মোরাটোরিয়াম’-এর চেহারা ও তার শর্তাবলী দিল্লি একতরফা নির্ধারণ করলেই চলবে না, তা রাজ্যেরও মনঃপূত হতে হবে। বস্তুত কাল মনমোহন-প্রণব বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বলে দাবি ওই আমলার।
গত মাসের গোড়ায় জাতীয় সন্ত্রাসদমন কেন্দ্র গঠন সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি এসে আর্থিক প্যাকেজের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মমতা। প্রধানমন্ত্রী মমতাকে বলেছিলেন, সংসদ অধিবেশন চলছে। ফলে রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা সম্ভব নয়। অধিবেশন শেষের আগের দিনই, ২১ মে রাজ্যপাল চিঠি দিয়েছেন প্রণববাবুকে।
আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যপালের ‘উদ্যোগ’ পেয়েছে রাজনৈতিক তাৎপর্য। কেন্দ্রের নেতাদের একাংশের মতে, রাজ্য মন্ত্রিসভাই রাজ্যপালকে দিয়ে চিঠিটি পাঠিয়ে থাকতে পারে, যাতে দিল্লির কাছে বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়। রাজ্যপাল নারায়ণন তাতে প্রণববাবুকে লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সঙ্কট এতটাই তীব্র যে, একে আর্থিক আপৎকালীন পরিস্থিতি (ইমার্জেন্সি) বলা যেতে পারে। আশা করছি, এর পরিত্রাণে আপনি বিচক্ষণতা দেখাবেন।’ রাজ্যের ঋণের পরিমাণ উল্লেখের পাশাপাশি আর্থিক পরিস্থিতিরও সবিস্তার বিবরণ দিয়েছেন রাজ্যপাল।
সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে দশ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও প্যাকেজ ঘোষিত না-হলেও মমতা আপাতত নীরব। নয়াদিল্লির রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশের ধারণা, কেন্দ্রের তরফে কিছু একটা ‘আশ্বাস’ পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী ধৈর্য ধরে রয়েছেন। অন্য দিকে কেন্দ্রও যে রাজ্যকে অনন্ত কাল অপেক্ষায় রাখতে চায় না, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তারও আভাস দিচ্ছে বলে এই মহলের দাবি। যদিও তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত, এমনকী পরোক্ষ আশ্বাসও মেলেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের এক সূত্রের যুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মুখে শরিকি ঐক্য অটুট রাখতে হলে কংগ্রেসকে তৃণমূলের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, যে ক্ষেত্রে বড় অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে পশ্চিমবঙ্গের জন্য আর্থিক প্যাকেজ। মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান সদস্যের কথায়, “ইউপিএ জোটে সঙ্কট রোখার জন্যও কিছু একটা প্যাকেজ ঘোষণা জরুরি।”
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে ‘স্পেশ্যাল কেস’ হিসেবে দেখালে কেরল-পঞ্জাবও তো অবধারিত ভাবে প্যাকেজ দাবি করবে! তখন কেন্দ্র কী ভাবে সামাল দেবে?
তখন ওই দুই রাজ্যের জন্যও দিল্লি কিছু প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে বলে জানান অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা। |