কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে কংগ্রেসের কাজকর্মে তিনি যারপরনাই ‘ক্ষুণ্ণ’। কিন্তু ইউপিএ ছেড়ে আসার মতো ‘হঠকারিতা’ও দেখাতে চান না। এই পরিস্থিতিতে আজ, শনিবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সংক্ষিপ্ত কলকাতা সফরে তাঁকে পরোক্ষে নিজস্ব ‘অনুযোগের বার্তা’ দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী তথা ইউপিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের দেউলিয়া অবস্থা নিয়ে বহু অনুরোধেও কেন্দ্রের ‘বিশেষ আর্থিক সাহায্য’ বা ‘মরেটোরিয়াম’ না-পাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী যথেষ্ট ‘ক্ষুণ্ণ’। পেট্রোলের দামও বেনজির ভাবে বাড়ানো হয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শরিকের সঙ্গে আলোচনা না করেই। ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমে যার প্রতিবাদ করেছেন মমতা এবং বর্ধিত মূল্য পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন। সাধারণ ভাবেও কংগ্রেসের কাজকর্মে যে তিনি ‘ক্ষুব্ধ’, নিজস্ব বৃত্তে তা গোপন করেন না মমতা। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “কংগ্রেস আমাদের মতো শরিককে গুরুত্বই দেয় না! প্রধানমন্ত্রী ভাল মানুষ। কিন্তু কংগ্রেস তাঁর কথা আদৌ শোনে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ দেখা দিয়েছে।”
তৃণমূলের অন্য এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতির পণ্ডিত। আমজনতার কথা ভাবছেন না। |
একান্তে হাল্কা মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার ডায়মন্ড হারবারে অশোক মজুমদারের তোলা ছবি। |
মমতাদিকে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাজেট অধিবেশনের পর রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থার বিষয়টি নিয়ে কিছু করবেন। অথচ এখনও কোনও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত, এমনকী কোনও পরোক্ষ আশ্বাসও মেলেনি।”
প্রধানমন্ত্রী আসছেন ঘণ্টা তিনেকের জন্য। দু’টি কর্মসূচি। একটি সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। দ্বিতীয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে মনমোহন যাবেন সল্টলেকে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঘণ্টা মতো থেকে সড়কপথে যাবেন রেসকোর্স হেলিপ্যাডে। হেলিকপ্টারে বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে দিল্লির পথে। শুক্রবার মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুরো সময়টাই নিজেকে ঈষৎ ‘দূরত্বে’ রাখতে চান মুখ্যমন্ত্রী। যে কারণে একান্ত সাক্ষাৎকারের জন্যও সময় চাননি। তৃণমূলের একাংশের মতে, এটা আমজনতার প্রতিও একটা বার্তা যে, তিনি ‘জনবিরোধী’ সরকারের থেকে ‘দূরত্ব’ রাখছেন। আবার দলের অন্য অংশের মতে, প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাতে রেসকোর্স হেলিপ্যাডে তো যাচ্ছেন মমতা। ফলে এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা অনুচিত।
গত বছর ২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে এসেছিলেন। সে বার কিন্তু বিমানবন্দরেই স্বাগত জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এ বারে তালিকায় রেখেছেন মন্ত্রিসভার তিন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অমিত মিত্র এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। সল্টলেকে পাঠাচ্ছেন অর্থমন্ত্রীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মমতা যাবেন। তবে মঞ্চে নয়, তিনি বসবেন নীচে, অন্যান্য দর্শকের সঙ্গে। এর পর রেসকোর্স হেলিপ্যাডেই মনমোহনকে ‘বিদায়’ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যাবেন মহাকরণে।
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে মুখ্যমন্ত্রীকে যে বিমানবন্দরে যেতেই হবে, এমন কোনও ‘প্রোটোকল’ নেই। যা রয়েছে রাজ্যপালের ক্ষেত্রে। তবে এটা চালু ‘রীতি’। মমতা যা সচেতন ভাবেই ভাঙতে চান। রাজ্য প্রশাসনের একাংশে অবশ্য জল্পনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী যদি মঞ্চে ডাকেন বা রেসকোর্স যাওয়ার সময় গাড়িতে তুলে নেন? কিংবা হেলিকপ্টারে সঙ্গে যেতে বলেন বিমানবন্দর পর্যন্ত? প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী ভেবে রেখেছেন, রেসকোর্স থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গ দিতে তিনি রাজ্যপালকে অনুরোধ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মঞ্চ থেকে ডাক এলে কী করবেন, তা অবশ্য এখনও ভাবেননি। তবে রেসকোর্স পর্যন্ত বুলেট-নিরোধক বিএমডব্লিউয়ে সওয়ার হওয়ার অনুরোধ এলে সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করবেন, এমনই ভেবে রেখেছেন। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “প্রধানমন্ত্রীর মতো কনভয় নিয়ে নয়, তিনি সাধারণের মতো চলাফেরাতেই স্বচ্ছন্দ। সেই কথাই সবিনয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেন তিনি।”
কিন্তু তার পরেও মনমোহন জোরাজুরি করলে মমতা কী করেন, তা দেখার বিষয়। দেখার এ-ও যে, শেষ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সফরে মনমোহন ‘মমতা-বরফ’ গলাতে পারেন কি না! |