টানা ছয় দিন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। কোনও নড়ন-চড়ন নেই। ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢোকার আগে বর্ষা কি পথ হারিয়ে ফেলল?
২৫ মে পর্যন্ত কিন্তু নিজস্ব ছন্দে চেনা পথেই এগোচ্ছিল বর্ষা। কিন্তু ২৬ মে থেকে সে আটকে গিয়েছে একই জায়গায়। হিসেব মতো শুক্রবার বর্ষার দক্ষিণ মুখটির ঢোকার কথা ছিল কেরলে। উত্তর মুখটি পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল মায়ানমার-মিজোরাম সীমান্তে। অথচ এ দিন দক্ষিণ মুখটি রয়েছে শ্রীলঙ্কা থেকে কিছুটা নীচে। উত্তর মুখ মায়ানমারের দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁই-ছুঁই।
আবহবিদেরা বলছেন, এত দিনে গোটা শ্রীলঙ্কায় বৃষ্টি নামিয়ে বর্ষার দক্ষিণ মুখটি আরব সাগরের পথে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত তা দক্ষিণ শ্রীলঙ্কা ছাড়ায়নি। আরব সাগরে পৌঁছলে তবে তা কেরল দিয়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকবে। দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা ঢোকার কথা ৮ জুন। ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে তার সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু প্রথমেই হিসেবে গোলমাল করে ফেলায় এ বার বর্ষার শুরু নিয়ে আবহবিদেরা বেশ চিন্তিত।
বর্ষার এই ব্যবহার কি অস্বাভাবিক?
আবহবিদেরা অবশ্য এই মুহূর্তেই তা মনে করছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ৫ জুনের মধ্যে যদি বর্ষা কেরলে ঢুকে যায়, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু তার থেকে দেরি হয়ে গেলে অবশ্যই কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি। আর দু’দিনের মধ্যে বর্ষা যদি তার অবস্থান থেকে না নড়ে, তাহলে তা চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। গত ১০ বছরের মধ্যে বর্ষা বেশ খানিকটা দেরি করে ফেলেছিল ২০০৫ সালে। সে বার বর্ষা কেরলে ঢুকেছিল ৫ জুন। দক্ষিণবঙ্গে ঢুকেছিল ১৮ জুন। এ বারও বর্ষা ৫ জুন কেরলে ঢুকবে কি না, তাই নিয়ে আবহবিদদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
কিন্তু কেন এই দেরি?
আবহবিদেরা বলছেন, দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগর-আরব সাগর হয়ে ভারতে ঢোকে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বায়ুপ্রবাহ কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার যে কোনও পরিবর্তন বর্ষার অগ্রগতিকে প্রভাবিত করতে পারে। তার দ্রুত এগিয়ে যাওয়া কিংবা হঠাৎ থমকে যাওয়া সবটাই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপরে নির্ভরশীল। এক আবহবিদ বলেন, “বর্ষা একটা নির্দিষ্ট ছন্দে এগোয়। প্রকৃতিরই একটা করে ধাক্কা ওই ছন্দ নিয়ে আসে।” সেই ধাক্কাটা হতে পারে নিম্নচাপ, হতে পারে ঘূর্ণাবর্ত অথবা অন্য কোনও প্রাকৃতিক পরিস্থিতি। এ বার ২৬ মে শ্রীলঙ্কায় বর্ষা ঢোকার পর থেকে আর কোনও ধাক্কা আসেনি। “বর্ষা এখন সেই ধাক্কাটার জন্যই অপেক্ষা করছে।” দিল্লির মৌসম ভবন অবশ্য জানাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সমুদ্রে বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সোমবারের মধ্যে ‘ধাক্কা’ আসতে পারে। সেই ‘ধাক্কা’য় বর্ষা একেবারে কেরল পার করতে পারবে বলেই আপাতত আশা করছেন আবহবিদেরা।
ভারতীয় ভূখণ্ডে এক বার ঢুকে পড়লে কিন্তু এই মুহূর্তে বর্ষাকে ‘ধাক্কা’ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা প্রস্তুত রয়েছে। বতর্মানে দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে আবহাওয়ার যা পরিস্থিতি তাতে বর্ষা মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়লে তা সহজেই উত্তর-পশ্চিম বরাবর উঠে আসতে পারবে বলে মনে করছেন আবহবিদেরা। বছরের এই সময় তাপমাত্রা বেশি বাড়লে গরম বাতাস উপরের দিকে উঠে যায়। তার ফলে তৈরি হয় নিম্নচাপ, যা বর্ষাকে টেনে আনে। গত কয়েক দিন ধরে রাজস্থান ও সংলগ্ন এলাকায় তাপপ্রবাহ চলছে। এ দিনই রাজস্থানের চুরুতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে গিয়েছে ৪৮.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বর্ষা যদি ভারতে ঢুকতে আরও দেরি করে, তখন এই পরিস্থিতি থাকবে কি? নিশ্চিত নন আবহবিদেরা। সে ক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম মুখেও বর্ষার গতি কমে যেতে পারে।
বর্ষার অন্য যে মুখটি এখন মায়ানমারের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে, সেটি পৌঁছনোর কথা ছিল মিজোরাম সীমান্তে। তা হলে ৫ জুন নাগাদ তা পৌঁছতে পারত উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। তখন বর্ষার গতিপথে প্রার্থিত ‘ধাক্কা’ আনতে পারত বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে এখন নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি নেই বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। তাই বর্ষার দক্ষিণ মুখটি কবে ‘ধাক্কা’ খেয়ে চলতে শুরু করবে, তা এখন বলা যাচ্ছে না।
বর্ষা এ বার এতটা দেরি করে ফেলায় দক্ষিণবঙ্গের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিও আরও চেপে বসবে বলে মনে করছেন আবহবিদেরা। তাঁরা বলছেন, পরিমণ্ডলে মেঘ ঢুকবে যথেষ্ট। কিন্তু স্বস্তি দেওয়ার মতো বৃষ্টি হবে না। বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু বৃষ্টি হতে পারে।
সেই বৃষ্টির পরে ফের আর্দ্রতা মাত্রাছাড়া হয়ে অস্বস্তি বাড়াবে। দক্ষিণবঙ্গের উপরে থাকা দুর্বল জোড়া ঘূর্ণাবর্তের জেরে উত্তরবঙ্গে ঝড়বৃষ্টি হবে বলে জানাচ্ছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর।
|