দু’দশক আগে চরম আর্থিক সঙ্কট থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। গত কাল প্রকাশিত আর্থিক পরিসংখ্যান ফের সেই সঙ্কটের ভ্রূকুটির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দেশকে। এহেন পরিস্থিতিতে শিল্পমহল থেকে অর্থনীতিবিদ, সকলেরই দাবি, এ বার ‘যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে’ মাঠে নামুক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার।
২০১১-১২ আর্থিক বছরের শেষ তিন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫.৩ শতাংশ। গত ৯ বছরে সব চেয়ে কম। ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষে, মন্দার সময়েও অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি। ফলে ১৯৯১-এর সঙ্কট ফিরে আসার আশঙ্কা করতে শুরু করেছেন অনেকেই। কেন্দ্রের অবশ্য দাবি, পরিস্থিতি এতটা করুণ নয়। কিন্তু শিল্পমহল বলছে, সঙ্কট তৈরি হয়েছে ধরে নিয়েই কড়া পদক্ষেপ করা হোক।
আজ সরকারের রক্তচাপ বাড়িয়েছে আর্থিক পরামর্শদাতা সংস্থা মর্গান স্ট্যানলি। চলতি অর্থবর্ষের শুরুতে তাদের পূর্বাভাস ছিল, আর্থিক বৃদ্ধির হার হবে ৬.৯ শতাংশ। দু’সপ্তাহ আগেই সেই পূর্বাভাস পাল্টে ৬.৩%-এ নামিয়ে এনেছিল তারা। আজ তা আরও কমিয়ে ৫.৩ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ফিকি-র মহাসচিব রাজীব কুমারের মতে, চলতি অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৫%-এ পৌঁছনোই যথেষ্ট কঠিন হবে। ভারতের অর্থনীতিকে শ্বাসরোধ হয়ে আসা হাতির সঙ্গে তুলনা করেছে এইচএসবিসি। সংস্থার মতে, আগামী দু’বছর মূল্যবৃদ্ধির চড়া হার ও আর্থিক বৃদ্ধির শ্লথতা মেনে নিয়েই চলতে হবে।
মনমোহন-সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব তো বটেই, অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কেও এ জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন শিল্পপতি ও লগ্নিকারীরা। পরিস্থিতি শোধরাতে আরম্ভ করেছে বলে গত কাল প্রণববাবু যে যুক্তি দিয়েছিলেন, তা মানতে রাজি নয় শিল্পমহল। প্রণববাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের থেকে কর আদায় নিয়ে যে কড়া মনোভাব দেখিয়েছেন, তাতেই বিনিয়োগে ধাক্কা লেগেছে। শিল্পপতি সজ্জন জিন্দল বলেন, “আমেরিকা-ইউরোপে মন্দার জেরে সবাই যখন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে লগ্নির কথা ভাবছেন, তখন অভ্যন্তরীণ কারণে বিনিয়োগ আসছে না এ দেশে।” ফিকি-র মহাসচিবের মতে, “এখন সব থেকে জরুরি লগ্নিকারীদের আস্থা ফেরানো। তাই সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।”
কী সেই সংস্কার? সিআইআই-এর সভাপতি আদি গোদরেজের দাবি, পণ্য-পরিষেবা কর চালু করা হোক। ভর্তুকিতে কাটছাঁট করা হোক। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হোক। কিন্তু শিল্প মহলের বক্তব্য, ভর্তুকি না কমিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কিছু ‘প্রতীকী পদক্ষেপ’ ঘোষণা করেছেন প্রণববাবু। ছোট ছোট প্রতিশ্রুতি, আশ্বাসমূলক বিবৃতি দিয়ে শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আদি গোদরেজের মতে, “পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার। শুধু কথায় আর কাজ হবে না।”
২০০৮-’০৯ সালে ‘আর্থিক স্টিমুলাস’ ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। কিন্তু এখন রাজকোষের যা অবস্থা, তাতে আর সে পথে হাঁটা সম্ভব নয়। সুদের হার কমানো গেলে লগ্নিতে কিঞ্চিৎ উৎসাহ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি বলে সে ব্যাপারে অনিচ্ছা দেখাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। জেপি মর্গানের অর্থনীতিবিদ সাজিদ চিনয়েরও বক্তব্য, “মূল্যবৃদ্ধির হার এখনও ৭ শতাংশের উপরে, টাকার দাম তলানিতে। তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের খুব কিছু করার নেই।” |