ছেলের পরীক্ষার ফল বেরোনোর পরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন রাবেয়া বিবি। মনে পড়ে যাচ্ছিল, বছর চারেক আগের এক দিনের কথা। স্বামী আমির আলি মল্লিক জোর করেছিলেন, ছেলে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে এ বার তাঁর সঙ্গে চাষবাসে হাত লাগাক। বর্ধমানের রায়নার জোৎসাদি-বড়কয়রাপুর গ্রামের রাবেয়া বিবি তা মানতে চাননি। শেষ পর্যন্ত তাঁর জেদ ভাঙতে না পেরে তাঁদের সংসার ছেড়েই বেরিয়ে যান আমির আলি। অন্যত্র বিয়ে করে সংসার পেতেছেন তিনি। আর চারটি বছর দাঁতে দাঁত দিয়ে অসম্মান ও দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন রাবেয়া। কিন্তু ছেলে ফাইহাজের পড়া বন্ধ হতে দেননি।
ফাইহাজ এ বার মাধ্যমিকে পেয়েছে ৫৮০। রাবেয়া বলেন, “স্বামী চলে যাওয়ার পরে দিনরাত সেলাই করে, নিচু ক্লাসের শিশুদের পড়িয়ে যেটুকু রোজগার করতাম, তাই দিয়ে সংসার টেনেছি।” তবে ফাইহাজের পড়াশোনার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় রায়নার মূলকাটি গ্রামের আল আমিন মিশন। মিশনের সম্পাদক আসফার হোসেন বলেন, “ফাইহাজ আমাদের মুখ রেখেছে। আগামী দিনেও আমরা তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেব।” ফাইহাজ বলে, “মা আমার জন্য যে লড়াই করেছিল, তার মর্যাদা রাখতে পেরেছি। এ বার চাই আরও অনেক দূর যেতে।”
পুরুলিয়ার হুড়া থানার কুলগোড়া হাইস্কুলের প্রশান্তকুমার গোপ পূরণ করতে পেরেছে তার বাবার স্বপ্ন। পরিচিতদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নিতে হয়েছে পাঠ্যবই পর্যন্ত। তারপরে সে পেয়েছে ৫৫৭ নম্বর। বাবা চণ্ডীচরণ গোপ ওই স্কুলেরই ছাত্রাবাসের পাচক। মা মুড়ি ভাজার কাজ করেন। স্কুলের শিক্ষকরাই এই মেধাবী ছাত্রের পরিবারের অবস্থার কথা ভেবে তাকে ছাত্রাবাসে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপন মণ্ডল বলেন, “প্রশান্ত শুধু ভাল ফলই করেনি, স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে।” |
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে পূর্ব মেদিনীপুরের পঁচেটগড় হাইস্কুলের ছাত্রী এগরা শহরের কসবা এগরার বাসিন্দা দেবলীনা মহাপাত্রও। ৬৬০ নম্বর পেয়েছে সে। বাবা অমৃত মহাপাত্র হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি জানান, খুব অল্প বয়সেই দেবলীনার হৃৎপিণ্ডের দু’টো ভালভের কার্যক্ষমতা কমে যায়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আর দু’বছরের মধ্যে ভালভ দু’টি প্রতিস্থাপন করতে হবে। দেবলীনার কথায়, “একটানা পড়তে পারি না। সারা দিনে মোট ৬-৭ ঘণ্টা পড়েছি। লক্ষ্য একটাই, বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করব।”
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের ভাটপাড়া মণ্ডলপাড়ার শ্রেয়সী বিশ্বাসও দু’বছর ধরে লড়াই করছে স্নায়ুরোগের সঙ্গে। কোনওমতে দোকান চালিয়ে
সংসার সামলান বাবা অরুণ বিশ্বাস। মেয়ের চিকিৎসাও করাতে নাজেহাল হন। তার মধ্যেই কিন্তু ৫৯৫ নম্বর পেয়ে অবন্তীপুর মণ্ডলপাড়া গার্লস হাইস্কুলের মাধ্যমিকের ফলাফলে রেকর্ড গড়েছেন শ্রেয়সী। ঘরের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভারী বৃষ্টিতে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে। তবু অভাবের সংসারে শ্রেয়সী কিন্তু স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার। শ্রেয়সীর কথায়, “আমার পড়ার খরচ চালাতে বাবা রোজ দশ-কুড়ি টাকা বাজার খরচ থেকে সরিয়ে রাখে। আমাকে যে ডাক্তার হতেই হবে।”
মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বাদশাও ছুঁতে পেরেছে নিজের তৈরি লক্ষ্যই। বাবা নেই। দুর্ঘটনায় কাটা পড়েছে ডান হাতের তিনটি আঙুল। তার মধ্যেই প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করতে হয় দিনে একশো টাকা মজুরির জন্য। হাতের দু’টো আঙুলেই কলম ধরে শ্রীকান্তবাটি হাইস্কুল থেকে ৫০৭ পেয়েছে সে। কিন্তু মা চামেলি বিবি বলেন, “আমি বিড়ি বেঁধে যা পাই, তাতে সংসার চলে না। কারখানার মজুরিটা না পেলে আমাদের সংসার চলবে না। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।” তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল মণ্ডল বলেন, “ ওকে সব রকম সাহায্য করব আমরা।”
নদিয়ার বাবলারি পঞ্চায়েতের দাসপাড়ার কৃষ্ণ দাসও নতুন বছরের পত্রিকা হাতে পেলেই সবার আগে বিয়ের দিনগুলো দাগ দিয়ে রাখে। ওই দিনগুলো যে অনুষ্ঠান বাড়িতে বাজনা বাজাতে যেতে হবে বাবা-দাদুর সঙ্গে। বিয়ের দিনে সকালেই বেরিয়ে পড়ে। ফিরতে ফিরতে রাত পেরিয়ে যায়। তবু এর মধ্যেই নবদ্বীপের আরসিবি সারস্বত মন্দির থেকে এ বছর মাধ্যমিকে ৫৬৭ পেয়েছে সে। কৃষ্ণর বাবা সুনীল দাস বলেছেন,“যা করেছে সবটাই নিজের চেষ্টায়। ছোট থেকেই ব্যান্ডপার্টিতে বাজাতে নিয়ে যাই ওকে। একজনের পারিশ্রমিক বাঁচে তাতে।” কৃষ্ণ বলে, “আমার খুব ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। তবে জানি না আদৌ তা করতে পারব কী না।”
|
প্রতিবেদন: রানা সেনগুপ্ত, প্রশান্ত পাল, অমিত করমহাপাত্র, বিতান ভট্টাচার্য, বিমান হাজরা, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: উদিত সিংহ, প্রদীপ মাহাতো, কৌশিক মিশ্র, অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায় ও সুদীপ ভট্টাচার্য |