টাকার অভাবে কখনও বেড়াতে যায়নি শ্রেয়সী। কিন্তু অনেক দূরে ট্রেনে চেপে বেড়াতে যাওয়ার বড় শখ ষোলো পেরনো এই কিশোরীর।
ঘরের পলেস্তারা খসেছে। ভারি বৃষ্টিতে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে। সারানোর সামর্থ্য নেই। তবু অভাবের সংসারে শ্রেয়সী স্বপ্ন দেখে, ডাক্তার হবে।
শ্রেয়সী বিশ্বাসের বাড়ি ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ভাটপাড়া মন্ডলপাড়ায়। ঘিঞ্জি এলাকা। কুলি, শ্রমিক নিম্ন আয়ের মানুষের বাস। ভাঙাচোরা রাস্তার ধারে ছোট্ট গুমটি। সিঁদুর, আলতা, টিকটিকি-লজেন্সের সঙ্গে তরি-তরকারিও বেচেন শ্রেয়সীর বাবা অরুণ বিশ্বাস। সংসার চলে টেনেটুনে। কিন্তু মেয়ের পড়ার খরচ বিস্তর।
এর মধ্যে আবার আছে অসুখ-বিসুখ। বছর দু’য়েক আগে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয় শ্রেয়সী। মাথা ঘোরা, চোখের যন্ত্রণা আর সেই সঙ্গে অসহ্য পেটের ব্যথা। মাধ্যমিকের ইংরেজি পরীক্ষার আগের দিনও প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অসুখের চিকিৎসায় খরচ প্রচুর।
এই টানা-পোড়েনের সংসারেই শ্রেয়সী এ বার মাধ্যমিক দিয়েছিল। মেয়ের রেজাল্ট আনতে গিয়ে চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল অরুণবাবুর। আনন্দ, যন্ত্রণা আর শঙ্কা মেশানো একটা অনুভূতি। শ্রেয়সী মাধ্যমিকে ৫৯৫ পেয়ে তার স্কুলের ইতিহাসেই ‘রেকর্ড’ গড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় অবন্তীপুর মণ্ডলপাড়া গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নমিতা চৌধুরী। নমিতাদেবী বলেন, ‘‘আমাদের ‘সেরা’ ছাত্রী শ্রেয়সী। ও শুধু আমাদের স্কুলের নয়, গোটা ভাটপাড়ার গর্ব। এত কষ্ট করে লেখাপড়া করা একজন ছাত্রীর পাশে আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে সব সময়ে আছি।’’
খুশির হাসি শ্রেয়সীর মুখেও। বাবার কষ্টার্জিত উপার্জনের কথা বলতে গিয়ে চোখের জল লুকোয়। বলে, ‘‘বাবার দোকানটাও ভাল চলে না। গৃহশিক্ষক রাখার মতো আর্থিক অবস্থা আমাদের ছিল না। তার মধ্যেই আমার পড়ার খরচ চালাতে বাবা রোজ দশ-কুড়ি টাকা বাজার খরচ থেকে সরিয়ে রাখে। আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। গরিব বাবার যন্ত্রণাটা আমি প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করি। মামার বাড়ি থেকেই পরীক্ষার আগে তিন জন গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর স্কুলের শিক্ষিকারা আমার পাশে ছিলেন প্রথম থেকে। তা না হলে এই রেজাল্ট অসম্ভব ছিল।’’ পাড়ার মেয়ের সাফল্যে খুশি প্রতিবেশীরা। আর শ্রেয়সীর মা কাকলিদেবীর ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই আছে।
স্কুলের রেজাল্টে বরাবরই প্রথম হওয়া শ্রেয়সীর পছন্দের বিষয় অঙ্ক। মাধ্যমিকে অঙ্কে পেয়েছে ৯৩। ভৌত বিজ্ঞানে ৯৬। বাংলাতে ৮৩, ভূগোলে ৮৬। শ্রেয়সীর বিনোদন বলতে বই পড়া। তা সে পাঠ্য বই হোক বা গল্পের বই। দুঃখের মধ্যেই দিন যাপন। তাই গল্পের বই মানেই শ্রেয়সীর পছন্দ হাসির গল্প। সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তীদের লেখা অনাবিল হাসি ফোটায় মেয়েটার মুখে। তবে বই কেনার টাকা নেই। বেশিরভাগ বই নানা পরীক্ষায় পুরস্কার হিসাবে পাওয়া। এত আনন্দের মধ্যেও শঙ্কা কাটছে না অরুণবাবুর। মেয়ের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কী ভাবে সফল হবে, তা ভেবে রাতের ঘুম উড়েছে। অরুণবাবু বলেন, ‘‘সংসার চলছে জোড়াতালি দিয়ে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মেয়ে ভাল রেজাল্ট করেছে। কিন্তু ওকে আমি কি পুরস্কার দেব? যা কিনতে যাই সাধ্যের বাইরে। ওর স্নায়ুর রোগের চিকিৎসার জন্যও অনেক খরচ। তবু ওকে পড়াব। ও চিকিৎসক হতে চায়। তার পড়ার খরচ অনেক বেশি। কোথা থেকে টাকা আসবে জানি না। মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে।’’ |