কামরা থেকে বেরোতে পারব, বিশ্বাস হচ্ছিল না
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিটকে পড়লাম মেঝেতে।
দুপুরের খাওয়া সেরে আপার বার্থে উঠে শুয়ে পড়েছিলাম। জৌনপুর ছেড়ে ট্রেন তখন বেশ জোরেই সাহাগঞ্জের দিকে ছুটছে। আমরা অফিসের জনা কুড়ি সহকর্মী যাচ্ছি উত্তর কাশী। ওখানে আমাদের একটা প্রশিক্ষণ শিবির হওয়ার কথা। নানা কথা ভাবতে ভাবতে, হালকা দুলুনিতে চোখের পাতা বুজে এসেছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ। উপরের বার্থ থেকে ছিটকে পড়লাম নীচে।
কামরার মধ্যে ধুলোর ঝড়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চিৎকার, কান্নাকাটির শব্দ। বুঝতে পারলাম, ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছে। আমাদের কামরাটা উল্টে গিয়েছে। এক জন আর এক জনের উপরে চাপা পড়েছে। আমার নীচের বার্থে সহকর্মী ভাস্কর সাহু শুয়েছিল, মনে আছে। চোখ একটু সয়ে যেতে ওকে খুঁজে পেলাম। কী করে বেরোব কামরা থেকে, সেটাই তখন একমাত্র চিন্তা আমাদের মাথায়।
আমি আর ভাস্কর নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। পরিবারের সবার মুখগুলো ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। সবাইকে ‘টা টা’ বলে কী আনন্দের সঙ্গেই না বেরিয়েছিলাম বুধবার! একটা দিন পরে এ কী অবস্থা আমাদের! এই অন্ধকূপ থেকে কি মুক্তি পাব? আবার কি দেখতে পাব পরিজনদের? কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন!
কিন্তু অনন্ত কাল হাত গুটিয়ে বসে থাকাও চলে না! বাঁচার একটা চেষ্টা করতেই হবে। আমার বার্থ ছিল ৬৪। দরজার পিছনে। হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছলাম দরজার কাছে। তার পরে কোনও দিকে না তাকিয়ে লাফ দিলাম নীচে। এত ক্ষণে দেখতে পেলাম কামরাটার হাল। চাকা খুলে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কামরাটা লাইনের বাইরে হেলে রয়েছে। পিছনের দিকের কামরাগুলো উল্টে পড়েছে। চারদিকে খাবারদাবার, নানা জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সিনেমার পর্দায় যেমন ট্রেন দুর্ঘটনার ছবি দেখেছি, একেবারে সেই রকম। শিউরে উঠলাম। এই সেই ট্রেন যেটা কিছুক্ষণ আগেও সদর্পে লাইনের উপর দিয়ে ছুটছিল? আমরা সবাই নিশ্চিন্তে কামরায় শুয়ে, বসেছিলাম! আর মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটে গেল!
আমরা নীচে নামতে পেরে প্রাণে বেঁচেছি। কিন্তু শুধু নিজেরা বাঁচলে তো হবে না! তখনও আটকে রয়েছেন আরও বহু যাত্রী। আমরা ফের পৌঁছে গেলাম দরজার কাছে। হাত ধরাধরি করে টেনে আনলাম কয়েক জনকে। কারও মাথা ফেটে গিয়েছে। কেউ নাড়াতে পারছেন না হাত। কারও কথা বলার শক্তিটুকুও নেই। উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা সবাই যে যার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরাও সহকর্মীদের খুঁজতে শুরু করলাম। ততক্ষণে দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রামগুলিতে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা এসে উদ্ধার কাজে হাত লাগালেন। মিনিট ২০/২৫-এর মধ্যে রেলের কর্মীরাও চলে এলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে উদ্ধারকাজ চলল। তার পরে আটটা বগিতে আমাদের সবাইকে তুলে সাহাগঞ্জে নিয়ে আসা হল। পিছনে পড়ে থাকল দুর্ঘটনাস্থল।
সাহাগঞ্জে আসার সময় আমরা সবাই কামরায় চুপচাপ বসেছিলাম। বাড়ির লোকেরা তখন বারবার ফোন করছে। সবাইকে শুধু একটা কথাই বলে চলেছি, বেঁচে আছি। আমি বেঁচে আছি। কানের মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছে সেই চিৎকার, আতঙ্কিত মানুষের কান্না, ছিটকে পড়া কামরার সেই প্রচণ্ড শব্দ! জানি না কত দিন লাগবে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে! তবু বেঁচে আছি, এটাই তো অনেক!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.