হাম্পি এক্সপ্রেসের পরে এ বার দেরাদুনগামী আপ দুন এক্সপ্রেস। মাত্র ন’দিনের ব্যবধানে ফের দুর্ঘটনায় রেল। তবে হাম্পির সঙ্গে দুনের তফাত একটাই। রেলের দাবি, এ ক্ষেত্রে চালক সতর্ক থাকায় বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ট্রেনটি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের কাছে লাইনচ্যুত হয় দুন এক্সপ্রেসের সাতটি কামরা। তার মধ্যে পাঁচটি কামরা পুরোপুরি উল্টে যায়। প্রাণ হারিয়েছেন চার জন যাত্রী। তবে আরও কয়েক জনের দেহ উল্টে যাওয়া কামরায় আটকে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। তাঁদের মধ্যে ১৮ জনের আঘাত গুরুতর। নিহতদের নিকট আত্মীয়দের ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। মৃতদের পরিবারের কেউ চাকরি চাইলে রেল মন্ত্রক তা বিবেচনা করবে বলেও জানিয়েছেন মুকুলবাবু। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও রেলের প্রাথমিক তদন্ত বলছে, হাম্পি এক্সপ্রেসের মতো এই দুর্ঘটনার কারণও রেলের ত্রুটি। অবশ্য নাশকতার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
|
আটক যাত্রীদের খোঁজে দুন এক্সপ্রেসের উল্টে যাওয়া কামরার ভেতরে
উঁকি দিয়ে দেখছেন পুলিশরা। বৃহস্পতিবার জৌনপুরের কাছে। ছবি: এ পি |
হাম্পি এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার ক্ষত মেলানোর আগেই ফের দুর্ঘটনায় উদ্বিগ্ন রেল কর্তারা। রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। আরও একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়ে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে, হাম্পির মতো এ ক্ষেত্রেও রেলের গাফিলতি রয়েছে। কিন্তু চালক-সহকারী চালকের সতর্কতার অভাব নয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। হাম্পি এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে চালক-সহকারী চালককে সাসপেন্ড করা হয়। রেল সূত্রের দাবি, দুন এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে কিন্তু ট্রেনের সহকারী চালক দূর থেকে লাইনে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করে আগেই ব্রেক কষেন। তার জেরে ইঞ্জিন-সহ ১০টি কামরা ঠিকমতো দুর্ঘটনাস্থল পেরিয়ে যেতে পেরেছিল বলে রেলের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। কিন্তু লাইনের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, পরের সাতটি কামরা লাইনচ্যুত হয়।
দিল্লিতে রেলবোর্ডের সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) এ পি মিশ্র বলেছেন, “প্রাথমিক ভাবে এই দুর্ঘটনার পিছনে রেল লাইনের ত্রুটি বলেই মনে করা হচ্ছে।” মিশ্র বলেন, “ট্রেনটি ঘণ্টায় ৯৫ কিলোমিটার বেগে চলছিল। তার মধ্যে হঠাৎ লাইনে ‘কিছু একটা দেখে’ চালক ব্রেক কষেন। ট্রেনের গতি আরও বেশি থাকলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা ছিল।” ট্রেনটি থেমে যাওয়ায় বেশি কামরা লাইনচ্যুত হয়নি। যা হয়েছে সেগুলি মূলত পিছনের কামরা। তা থেকে এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের ধারণা, মূল ত্রুটি লাইনের রক্ষণাবেক্ষণে।
কী ঘটেছিল এ দিন দুপুরে? বৃহস্পতিবার দুপুরে লখনউ ডিভিশন দিয়ে যাওয়ার সময় মাহিরাওয়ান স্টেশন পার করার পরে খেটাসরাল স্টেশনের ঢোকার আগে হোম সিগন্যালের কাছে আচমকা ইঞ্জিনের পর থেকে ১০, ১১, ১২, ১৩ এবং ১৪ নম্বর কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায়। যাত্রীরা প্রথমে প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পান। তার পরেই ট্রেনটি হেলে দুলে ঝাঁকুনি দিতে দিতে আস্তে আস্তে থেমে যায়। তত ক্ষণে লাইন থেকে ছিটকে পড়েছে সাতটি কামরা।
কেন ঘটল দুর্ঘটনা?
রেলের কর্তাদের কথায়, প্রচণ্ড গরমে তেতে গিয়ে রেল লাইন বেঁকে যায় (রেলের পরিভাষায় যাকে বাকলিং বলা হয়)। তার ফলে লাইন থেকে ট্রেনের চাকা মাটিতে পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের কথায়, এমনিতেই ওই এলাকায় এখন প্রচণ্ড গরম। ফলে লাইন বেঁকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। আর তাতেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। রেল বোর্ডের সদস্য এ পি মিশ্রও এই সম্ভবনার কথাই এ দিন উল্লেখ করেছেন।
তাপমাত্রার আচমকা ওঠানামার ফলে লাইনে চিড়ও ধরতে পারে। তবে এখন, এই গরমে তাপমাত্রা চট করে বদলাচ্ছে না। তাই চিড় ধরার সম্ভাবনা আপাতত নেই বলেই মনে করছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে লাইন বেঁকে যেতে পারে। তা ঠেকাতে বিশেষ প্রযুক্তিও রয়েছে। সেই রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আগে রেল করত। এখন তা বেসরকারি সংস্থা করে। রেলের কর্তা ও কর্মীদের একাংশ এবং ইউনিয়নের কর্মীদের অভিযোগ, সেই কাজটি যথাযথ ভাবে করা হয়নি। তাই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রেলের বক্তব্য, পূর্ব রেলের ট্রেনগুলি দু’টি রুটে দিল্লি যায়। একটি ইলাহাবাদ হয়ে। অন্যটি লখনউ হয়ে। প্রথম রুটটি দিয়ে রাজধানী যাতায়াত করে। দ্বিতীয়টি দিয়ে দুনের মতো কম গতির ট্রেনগুলি যায়। ফলে এই লাইনে নজরদারি, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির কাজেও গা ছাড়া ভাব আছে বলে রেল কর্তাদের একাংশের অভিযোগ। এ সবই এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে তাঁদের আশঙ্কা।
আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন। দুর্ঘটনাস্থলে যাঁরা আটকে পড়েছেন, তাঁদের জন্য জল এবং খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ট্রেন ও বাসের ব্যবস্থা করছে রেল। বিশেষ কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে হাওড়া, শিয়ালদহ, বারাণসী, লখনউ, হাজিপুর, ধানবাদ ও দিল্লিতে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মহাকরণেও খোলা হয়েছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম।
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দুর্ঘটনাগ্রস্ত কামরাগুলিতে এ রাজ্যের বেশ কিছু যাত্রী ছিলেন। অনেকেই এই সময় বেড়াতে যান। যাত্রী তালিকার নামগুলি দেখে হাওড়া থেকে কারা উঠেছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।” দুর্ঘটনার নিয়ে মমতা বলেন, “বন্ধের দিনে কী ভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটল, তা দেখতে হবে। জ্ঞানেশ্বীর ঘটনাতেও আমি দেখেছিলাম কী হয়েছে। এটা ‘ইন্সিডেন্ট’ না ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ তা রেল তদন্ত করে বলবে।” এ দিনের ঘটনায় কোনও কোনও মহল থেকে অর্ন্তঘাতের অভিযোগ তোলা হলেও তা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ তারা পায়নি বলেই জানিয়েছে রেল। |