ধর্মঘট, হরতাল, বনধ এই কথাগুলি কি নিছক প্রতিশব্দ? গত একশো বছরে খবরের কাগজের পাতায় বা লোকের মুখের অভ্যাসে কি শব্দগুলি পাল্টে গেছে, একই কর্মনাশা কর্মকাণ্ড বোঝাতে? সংস্কৃত থেকে উর্দু, উর্দু থেকে হিন্দি শব্দ বদলি হিসেবে এসেছে, না প্রতিটি শব্দের দ্যোতনাই আলাদা? ইংরেজ আমলে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘ধর্মঘট’ বা ষাটের দশকে তৎকালীন রাজ্যপাল ধর্মবীরের অনুজ্ঞায় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ার পরে বাংলার টানা দীর্ঘতম ‘হরতাল’ ঐতিহাসিক বলে খ্যাত ও অভিনন্দিত।
আমাদের আজকের কথাবার্তায় বনধ শব্দটি কবে থেকে জাঁকিয়ে বসল? চল্লিশের দশকে মহম্মদ ইসমাইলের ডাকে ‘চাক্কা বনধ’ হত। সত্তরের দশকে ইন্দিরার জমানায় রেলওয়ে বনধ, চাক্কা জ্যাম, লাগাতার সরকারি প্রচার, রেলওয়ে কলোনি অবরোধ, শেষ পর্যন্ত ধর্মঘটীদের আত্মসমর্পণ কি বনধ শব্দটি প্রতিষ্ঠা করল?
সপ্তদশ শতকের গুজরাতে, বাংলায় ধর্মঠাকুরের হাঁড়ি বসিয়ে যৌথ ভাবে লোকে প্রতিরোধ করার প্রতিজ্ঞা নিত। আবার ঘট ভেঙে এই প্রতিজ্ঞা পূরণ করত। সেই ধর্মিক ও সামাজিক ঐতিহ্যকে ভারতীয় রাজনীতিতে গাঁধী এক সার্বিক নৈতিক প্রতিরোধের অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। অবশ্যই তাঁর প্রকল্পেও কেউ কেউ জবরদস্তি চাপ দেখেছিল, ‘হরিজন’-এর পাতায় গাঁধী সেই অভিযোগের জবাবও দিয়েছিলেন। সঙ্ঘশক্তির নৈতিক উদ্বোধন ও দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। পঞ্চাশের দশকে বামপন্থী শ্রমিক নেতা যতীন চক্রবর্তীকে লোকে ‘হরতালদাদা’ বলে ঠাট্টা করত, ধর্মঘটের নৈতিক মাহাত্ম্যের কথাটি যেন হরতালে ধরা পড়ত। আর ‘বনধ’-এর মধ্যে গা জোয়ারি আছে, দাপট আছে, কিন্তু নৈতিকতা? |
খপ্ করে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, বুঝব কী করে? ভয় বা জোর বাদ দিয়ে কি বনধ হয়? যেমন বনধে আশঙ্কা থাকে, বাজার খুলবে তো? দোকান ভাঙচুর হবে না তো? যানবাহন চলবে? চললে বাস পুড়বে না? বৃহস্পতিবার সকালে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম, টুকটাক দোকান খোলা ছিল, তবে বেশির ভাগ দোকানদার আসেনি। যাদের বাড়ি কাছে, তারাই পসরা সাজিয়েছিল।
কলেজে গরমের ছুটি, তবে সরকারি সার্কুলার এসেছে, ফোনে অধ্যক্ষের আদেশ, তাই বাড়িতে ফিরে দেখি যে, শরীর খারাপ সত্ত্বেও স্ত্রী কলেজে গিয়েছেন। উভয়পক্ষেই শঙ্কা ও নির্দেশ, সার্কুলারে মাইনে কাটার হুমকি। এখানে নৈতিকতার স্থানই বা কোথায়?
আর এখানেই আজকের বনধের হাস্যকর দিক ফুটে ওঠে। বনধ সফল না বিফল? আজ বাজারে যাওয়ার সময়ে একটি রিকশাও পাইনি। আসার সময়ে পেয়ে গেলাম। আমার অভিজ্ঞতায় বনধ ৫০ ভাগ সফল, আর ৫০ ভাগ ব্যর্থ।
আসলে বনধ-এর রাজনীতি আর বনধ-এর সংস্কৃতির মধ্যে ফারাক আছে। বনধ হলে দিন নষ্ট হয়, রুজিরোজগার জাহান্নমে যায়, সাধারণ মানুষের হয়রানির অন্ত থাকে না। অথচ গণতন্ত্রে ধর্মঘট, থুড়ি, বনধ কিন্তু অবস্থা বুঝে সব দলই ডাকেন বা বিরোধিতা করেন। আর ডাকলে বা বিরোধিতা করলেই সব সময়ে শঙ্কা আর হুমকি, বনধ-এর সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে দড়ি টানাটানি। বনধ-এর রাজনীতি আজ আর স্বতঃস্ফূর্ত নয়, ন্যায্যতা বা অন্যায্যতা ততটা বিবেচ্য নয়, বরং সংগঠনের জোর আর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সেটি জড়িত।
আর বনধ কত দূর কার্যকর? আমজনতার পক্ষে না বিপক্ষে? নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব জানানোর জন্যই তো বনধ বা তাকে ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এরই মধ্যে আমার-আপনার মতো সাধারণ লোক তার বুদ্ধি ও সামর্থ্যমতো কাজ করবে। হয় বাড়িতে ঘুমোবে, নয় টিভি দেখবে। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবুর নির্ঝঞ্ঝাট সংস্কৃতিতে বনধ একটা ‘কনজিউমার সারপ্লাস’, কাজের দিনগুলির মধ্যে হঠাৎ পাওয়া ছুটি, আলসেমি ও গড়িয়ে নেওয়ার দিন। আজকাল অবিশ্যি রূপান্তর ঘটছে। সরকারি নির্দেশে অফিসে গণ-অবস্থিতির দিনগুলি ‘ফিস্টি’তে রূপান্তরিত হচ্ছে। আগের রাত থেকে জমিয়ে অফিসে ডিমের ডালনা ও ভাত খেয়ে, তাস খেলে পরের দিন তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটা দেওয়াটাই নাকি গত শিল্প ধর্মঘটের অভিজ্ঞতা ছিল। রাজনীতির দায় এ ভাবেই সংস্কৃতির উৎসবে রূপান্তরিত হয়, বারো মাসে তেরো পার্বণ তো বাঙালি সংস্কৃতিরই স্লোগান। আর অন্য দিকে গায়ে-গতরে খেটে খাওয়া মানুষেরা সম্ভব হলে সকাল সকাল পসরা বেচে বা দু’এক ফেরতা রিকশা চালিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দেবে। |