রাজ্য সরকারের বর্ষপূতির্র অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁর একমাত্র ‘ব্যথা’র জায়গা সিঙ্গুর। সোমবার সেই সিঙ্গুরের জেলা হুগলির ডানকুনিতে রেলপ্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়ে কার্যত সিঙ্গুরের ‘ক্ষতে’ই প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষি, খেতমজুরদের প্রতি তাঁর ‘বার্তা’ আদালতের রায় পেলেই সিঙ্গুরে শিল্পায়ন শুরু করবে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “সিঙ্গুরের জমি তো আমরা ইতিমধ্যেই নিয়ে নিয়েছি! তবে এখন মামলা চলছে। মামলা মিটে যাবে। সিঙ্গুরের সমস্যাও আজ না-হয় কাল মিটবেই।”
মমতার দাবি, রেল ও সেল (স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া) ইতিমধ্যেই সিঙ্গুরে কারখানা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। ৬০০ একর জমিতেই কারখানা হবে। সিঙ্গুরে জমি নিয়ে মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত ‘অনিচ্ছুক’ চাষি ও খেতমজুরদের জন্য মাসে হাজার টাকা সরকারি ভাতার কথা এ দিন ফের জানান মমতা। সেই সঙ্গে ‘অনিচ্ছুক’ চাষি, খেতমজুরদের জন্য সপ্তাহে ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতির কথাও উল্লেখ করেন। জানান, সিঙ্গুরে ইতিমধ্যেই ‘কিষাণ-ভিশান প্রকল্প’ চালু হয়েছে। ওই প্রকল্পের কাজ ঠিকঠাক চলছে কিনা, তা-ও মুখ্যমন্ত্রী জেনে নেন সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনে তাঁর অন্যতম ‘সৈনিক’ তথা হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্নার কাছে। ‘কাজ চলছে’ জেনে ‘সন্তুষ্ট’ হন মুখ্যমন্ত্রী। |
ডানকুনিতে ডিজেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সঙ্গে রয়েছেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। সোমবার প্রকাশ পালের তোলা ছবি। |
ডানকুনিতে দাঁড়িয়ে রাজ্যে শিল্পায়নের ‘উজ্জ্বল’ ভবিষ্যতের উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “সকলে এখন কলকাতায়, বাংলায় আসবেন। কারণ বাংলাই পথ দেখাবে।” সিঙ্গুর থেকে টাটারা বিদায় নেওয়ায় বাংলায় শিল্প বিনিয়োগের ‘রাস্তা অবরুদ্ধ’ করেছেন বলে মমতা ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। এ দিন ডানকুনিতে মমতার পাল্টা অভিযোগ, “এই রকম কারখানা আমরা হাওড়ার সাঁকরাইলেও করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে কারখানা করতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই ডানকুনিতেও রোজ লাল পতাকা পুঁতে বাধা দিয়েছে সিপিএম। কিন্তু এখানকার মানুষের সহযোগিতায় আমরা দু’বছরের মধ্যে কারখানা গড়ে তুলতে পেরেছি।”
দৃশ্যতই উচ্ছ্বসিত মমতা জানান, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৯-এর ২৬ ডিসেম্বর ডানকুনিতে ডিজেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার শিলান্যাস করেছিলেন তিনি। ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল সেই কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়। এ দিন সেই কারখানারই উদ্বোধন করলেন মমতা। ‘অল্প সময়ে’ কাজ শেষ হওয়ায় তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “একেই বলে কাজ!” আর পূর্বতন বাম সরকারকে কটাক্ষ, “কোনও কাজ পঁয়ত্রিশ বছর ফেলে রাখতে নেই!”
শিলান্যাসের পরেও নানা সময়ে এই কারখানার কাজ রাজনৈতিক আন্দোলনের জেরে ব্যাহত হয়েছে। সিপিএমের বাধাতেই প্রকল্পের কাজ প্রথম দিকে গতি পায়নি বলে রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের অভিযোগ। রেল সূত্রের খবর, ১৬১টি পরিবারকে প্রকল্পের জমিতেই পুনর্বাসন দিয়ে সেই পরিস্থিতি সামলানো হয়। জলাজমি ভরাট করে প্রকল্পের কাজ হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। সেই মামলা খারিজ হয়ে যায়। রেলের দাবি, এই কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বিশেষত হুগলিতেই রেলের বিভিন্ন প্রকল্প গড়তে তাঁর প্রচেষ্টাকে নানা ভাবে ‘কটাক্ষ’ করা হত জানিয়ে মমতা বলেন, “এখানে রেলের কাজের কথা যখন বলতাম, তখন অনেকেই বলত, প্রচারের জন্য সব বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজ করার ইচ্ছে থাকলে কাজ যে করা যায়, ডানকুনির এই কারখানাই তার প্রমাণ।” মমতা জানান, ডানকুনিতে রেলের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়া হবে। যেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি মিলবে রেলেই। ৪ জুন আরামবাগ থেকে তারকেশ্বর রেলপথের উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা মমতার। তিনি বলেন, “কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটি রেললাইনের জন্য জমি নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। মুকুলকে (রেলমন্ত্রী) বলব মিটিয়ে নিতে।”
রাজ্যের সর্বত্র শিল্পের প্রসার ঘটবে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজ্যে কর্মসংস্থানের জোয়ার বইবে।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, বাংলায় রেলের ১৬টি কারখানা হবে। তাঁর কথায়, “কাজের জোয়ারে আপনারা সবাই গা মেলান। আগামী দিন চকচক করবে বাংলা।’’ কিন্তু ভয়াবহ বেকার-সমস্যার কথা মাথায় রেখেই মমতার পরামর্শ, “ভাল চাকরি যখন পাবেন, তখন তো নেবেন। তবে না-পেলে হতাশ হবেন না। হতাশা জীবনের বড় শত্রু। যত চাকরির বিজ্ঞাপন দেখবেন, সবেতেই আবেদন করবেন। যতক্ষণ না-পাবেন, যা কাজ পাবেন তা-ই করবেন। কোন কাজই ছোট নয়।”
এ দিন ডানকুনিতেই বিদ্যুৎচালিত ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির আরও একটি কারখানা তৈরির কাজের সূচনা করেন মমতা। সঙ্গে রেলকর্তারা ছাড়াও ছিলেন কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রত্না দে নাগ প্রমুখ। |