মনবিন্দর সিংহ বিসলা কে? এই প্রশ্নের জবাবে যদি কেহ বলেন, তিনি ২০১২ সালের আই পি এল ফাইনালে কলিকাতা নাইট রাইডার্স দলের জয়ের প্রধান স্থপতি, তবে তাহা নেহাতই অর্ধভাষণ হইবে। মনবিন্দর সিংহ বিসলা ক্রিকেটের ভবিষ্যতের প্রতীক। তিনি ম্যাচ-জেতানো ইনিংস খেলিয়াছেন বলিয়া নহে, তিনি ভবিষ্যতের ক্রিকেটভাবনার সন্তান বলিয়া। নাইট রাইডার্স-এর জয়টি ক্রিকেটের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের জয়ের সূচক। কলিকাতার দলটি আই পি এল-এর প্রথম তিন বৎসরে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হইয়াছিল। চতুর্থ বৎসরটি ছিল ঘুরিয়া দাঁড়াইবার প্রস্তুতিকাল। পঞ্চম বৎসরে স্পষ্ট, ঘুরিয়া দাঁড়াইবার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হইয়াছে। অতীতের বিসর্জন হইয়াছে, ভবিষ্যতের আবাহন হইয়াছে। অতীত, অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্রিকেট। সেখানে দলের সাফল্য-ব্যর্থতা কোনও এক বিশেষ ব্যক্তির পারা-না পারার উপর নির্ভর করিয়া থাকে। সত্য, ইহাই ক্রিকেটের প্রচলিত ঘরানা। প্রথম তিনটি বৎসর নাইট রাইডার্স সেই ঘরানাতেই খেলিয়াছিল। তাহার ফল হইয়াছিল বিষম। গৌতম গম্ভীর এবং তাঁহার টিম ম্যানেজমেন্ট নূতন ধারণার ভগীরথ হইয়াছেন। ক্রিকেট আর তারকানির্ভর নহে। চেন্নাই সুপারকিংস-এর বিপুল রানের পাহাড় টপকাইতে নামিয়া প্রথম ওভারেই দলের সফলতম ব্যাটসম্যান আউট হইয়া গেলেও দল ভাঙিয়া পড়ে নাই। কোনও অজ্ঞাতনামা মনবিন্দর সিংহ বিসলা রানের পাহাড় চড়িবার দায়িত্বটি নিজের কাঁধে লইয়াছেন। লক্ষ্মীপতি বালাজি চোট না পাইলে তাঁহার হয়তো দলে ঠাঁই পর্যন্ত হইত না। সেই তিনিই অতিমানবীয় ইনিংস খেলিয়া দলের জয়ের রাস্তাটি প্রশস্ত করিয়া দিয়াছেন। একেবারে শেষ লগ্নে যখন বোধ হইতেছিল, হয়তো তীরে আসিয়া তরী ডুবিবে, তখন শীতল মস্তিষ্কে দায়িত্ব তুলিয়া লইলেন মনোজ তিওয়ারি। বিসলা বা তিওয়ারি সচিন তেন্ডুলকর নহেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও নহেন। ভারতীয় ক্রিকেটের অভিজাত কক্ষে হয়তো ভবিষ্যতেও তাঁহাদের স্থান হইবে না। তবু, তাঁহারাই জয় ছিনাইয়া আনিলেন। তাঁহারা আসলে নূতন দলের ফসল। সেই দলে তারকার দীপ্তির পূর্বে যূথবদ্ধ সৈনিকের স্থান। গৌতম গম্ভীরের প্রধান কৃতিত্ব, তিনি এই দলটি তৈরি করিতে পারিয়াছেন। দলের সদস্যদের বিশ্বাস করাইতে পারিয়াছেন, ব্যক্তির পূর্বে দলকে স্থান দিলে কিছুই অসম্ভব নহে।
নাইট রাইডার্সের এই শিক্ষাটি শুধুমাত্র ক্রিকেটের ময়দানেই সীমাবদ্ধ নহে। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই শিক্ষা সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে। এই রাজ্যে একটি ঐতিহাসিক কু-অভ্যাস আছে বাঙালিরা সর্বদাই অতিমানবের মুখাপেক্ষী। কোনও এক জন অসীম ক্ষমতাধর আসিয়া দায়িত্বের জোয়াল নিজের স্কন্ধে তুলিয়া লইবেন। সমগ্র জাতি হয়তো তাঁহার জয়ধ্বনি করিবে, কিন্তু কেহ স্বপ্রবৃত্ত হইয়া জোয়ালে কাঁধ দিবে না। সত্য, অতিমানবের ক্ষমতা সাধারণের থাকে না। কিন্তু, যে কাজ একার ক্ষমতায় কুলায় না, দলবদ্ধ ভাবে তাহা সাধ্য। কিন্তু এই কথাটি সম্যক ভাবে উপলব্ধি করিবার জন্য অতিমানব-নির্ভরতা ত্যাগ করা বিধেয়। বঙ্গবাসী এই কথাটি বুঝিতে চিরকালই অপারগ। অন্য দিকে, এই রাজ্যের জলহাওয়ায় যে ‘তারকা’-রা বাড়িয়া উঠেন, তাঁহারাও এই অতিমানবত্ব বিলক্ষণ উপভোগ করেন। এই হতভাগ্য বঙ্গে যে তাঁহাদের উপর নির্ভর না করিলে কিছুই হইবার নহে, এই কথাটি তাঁহারা যথাসাধ্য বুঝাইয়া দেন। বঙ্গবাসীও তাহাই বুঝিতে চাহেন। উভয়ের সাযুজ্যে একটি তারকানির্ভর সমাজ তৈরি হয়। যখন দেখা যায়, লাভ কিছুই হইতেছে না, তখন ক্ষোভ গিয়া পড়ে নেতার উপর। অপর কোনও নেতার সন্ধান শুরু হয়। চিন্তার এই বন্ধ্যাত্ব ভাঙা প্রয়োজন। গৌতম গম্ভীরের দল হাতেকলমে শিখাইয়াছে, নিতান্ত সাধারণও চেষ্টা করিলে অসাধারণ কীর্তিস্থাপন করিতে পারে। তারকার দ্যুতিকে ম্লান করিয়া দিতে পারে যূথবদ্ধ প্রচেষ্টার বিচ্ছুরণ। পশ্চিমবঙ্গ শিখিবে কি? |