|
|
|
|
অশনিসঙ্কেতেও জয়ের শপথ |
সহবাগের ভুল করতে চান না গম্ভীর |
গৌতম ভট্টাচার্য • চেন্নাই |
তাজ ক্লাব লাউঞ্জের সাত তলায় প্রতিক্রিয়ার তখন ত্রিমুখী রঙ! শনিবার সকাল ন’টা। ব্রেকফাস্ট টেবিলের এক কোণে চেন্নাইয়ে ছেয়ে যাওয়া জাপানি সংস্থাগুলোর কোনও একটায় পদস্থ অফিসার নিয়োগের ‘ওয়ান অন ওয়ান’ ইন্টারভিউ চলছে। তার বাঁ পাশে অসুস্থ তামিলনাড়ু রাজ্যপালের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে ফোনে কথা বলছেন বিদেশ থেকে আসা তাঁর পরিবারের কেউ। আর ঠিক ক্লাব লাউঞ্জের মুখে অবাধ্য ছাত্রকে ‘গার্ডিয়ান টু সি’ করা হলে সে যেমন ভঙ্গিতে মাথা চুলকে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই শরীরী ভাষাতেই দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের এক কর্তা। কড়া দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল। কর্তাটি মাথা নিচু করে তাঁকে বোঝাচ্ছেন, আমাদের যে সিদ্ধান্তগুলো কাল চূড়ান্ত অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, সেগুলোর পিছনে কোনও না কোনও ক্রিকেটীয় যুক্তি ছিল।
শুক্ল ব্যাখ্যা শুনে খুব প্রসন্ন হলেন কি না, বোঝা গেল না। সেমিফাইনালে দিল্লির ৮৬ রানে পিষ্ট হওয়ার ম্যাচ কোনও কোনও মহলে আইপিএল সম্পর্কে সংশয় বাড়িয়েছে। হতাশ আইপিএল প্রধান জেনেছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ভনভন করছে এই মন্তব্যে যে, আইপিএল সম্পূর্ণ গড়াপেটা, এর পর বুঝে নিতে আর কী অসুবিধে আছে? একটু পর জানা গেল, ফেসবুক বা টুইটার কী, দিল্লি টিমের রিজার্ভে থাকা কোনও কোনও বিদেশিও শুক্রবার মাঝ রাতে সাপোর্ট স্টাফের কাছে জানতে চান, কিছুই বুঝলাম না। ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে।
যাঁর ভয়ঙ্কর তিন সিদ্ধান্ত নিয়ে আইপিএলের আকাশ বাতাস এমন ঘোলাটে, সেই বীরেন্দ্র সহবাগকে দেখা গেল কিছু পরে। তিনি অবশ্য শুক্লের কাছাকাছি নেই। নীচের লবিতে বৈঠক সারতে যাচ্ছেন। হাঁটাচলায় সেই সহবাগোচিত ভাব একেবারেই নেই। বীরুবাবু কেমন যেন মিইয়ে পড়েছেন। বললেন, “অ্যান্টিবায়োটিকেও শরীরটা কিছুতেই জুতে আসছে না।” |
|
মহাপরীক্ষার আগে লক্ষ্যে স্থির।
চেন্নাইয়ে উৎপল সরকারের তোলা ছবি। |
রবিবার রাত সাড়ে সাতটায় চিদম্বরম স্টেডিয়ামের বাইশ গজে টস করতে এগিয়ে যাবেন দুই অধিনায়ক গম্ভীর আর ধোনি। লড়াই আইপিএল ট্রফিটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। চেন্নাইতে এ দিন ক্রিকেটমহলকে সেমিফাইনালের চূড়ান্ত হ্যাংওভারে আচ্ছন্ন থাকতে দেখে কোথাও মনে হল, ট্রফির গায়ে তিন জনের ছায়া পড়েছে। তৃতীয় ব্যক্তির নাম বীরেন্দ্র সহবাগ। চেন্নাই এমন পিষে মেরেছে সহবাগদের যে আইপিএল ফাইনালে সিএসকে শুধু ফেভারিট নয়, সাধারণ ধারণায় যেন অবিসংবাদী ফেভারিট। সাকিব আল হাসান কম কথায় চমৎকার বলেছেন, “ফাইনাল হল টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ধারাবাহিক দলের বিরুদ্ধে আইপিএলে সবচেয়ে ভাল রেকর্ড থাকা দলের লড়াই।” কিন্তু সে সব শুনছে কে? যাবতীয় ঢক্কানিনাদ, আবেগ আর চূড়ান্ত বিশ্বাস ধোনির দলকে ঘিরে। গম্ভীরদের জন্য শুধুই অশনিসঙ্কেত।
এক এক সময় মনে হচ্ছিল, আশির দশকে ভারতীয় দলের যেমন ছিল অভিশপ্ত ‘শারজা’, চেন্নাই কি তেমনই দুর্জয়, দুর্ভেদ্য? কপিল দেব তখন বলেছিলেন, “পাকিস্তানকে করাচিতেও খেলতে রাজি, কিন্তু শারজায় নয়।” এ দিন দিল্লি টিমের কেউ কেউ বলছিলেন, পুরো মাঠটা হলুদ জার্সিতে ঢেকে যায়। আউটফিল্ডে যারা দাঁড়ায়, তাদের হলুদ জার্সিগুলো এমন নার্ভাস করে দেয় যে, কাল ওয়ার্নারের মতো ভাল ফিল্ডার ক্যাচ ফেলে দিয়েছে।
উইকেটে প্রথম বল পড়ার আগেই একটা টিমকে বেদিতে তুলে দেওয়া, অন্য টিমকে নামিয়ে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে, কোথাও কি তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালের ছায়া পড়ে গেল? সে বার লর্ডসে ১৮৩ রানে অল আউট হওয়ার পর কপিলদের স্ত্রীরা নিশ্চিত হার জেনে হোটেলে ফিরে যান। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা ম্লান একটা আউটফিটকে সেই সময় ড্রেসিংরুমে কপিল চাগাচ্ছেন, “চলো জওয়ানো, লড়কে দিখায়েঙ্গে!” বাকিটা ইতিহাস। গম্ভীর তিনি কী বলবেন প্রবল পরাক্রান্ত হলুদ জার্সির মহড়া নেওয়ার আগে?
কপিলের ভারতের অবশ্য দল বাছার এত সমস্যা ছিল না। গম্ভীরের কেকেআরের যা হচ্ছে। বালাজি হঠাৎ করে হ্যমস্ট্রিংয়ের চোটে ছিটকে যাওয়ায় যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তা দেখে মনে হচ্ছে সত্যি ধোনিকে ভাগ্যের বরপুত্রই বলা উচিত। নাইটরা ভেবে কূল পাচ্ছে না, কে বালাজির অভাব ভরাবে? ব্রেট লি? নাকি দেশীয় কোনও পেসার? প্রদীপ সাঙ্গওয়ান আর মহম্মদ সামিকে নিয়ে ট্রেনিং করাতে গেলেন আক্রম। যা দেখে টিমের মধ্যেই ফিসফাস: এ কী রে, এরা কেউ খেলবে নাকি? এঁদের মধ্যে সামি একটা ম্যাচও খেলেননি। সাঙ্গওয়ান এক ম্যাচে গড়ে ৪২ রান দিয়ে এক উইকেট পেয়েছেন। ব্রেট লি-কে নিয়ে নিলে এমনিতে সমস্যা নেই। কিন্তু তা হলে আবার বিদেশিদের কম্বিনেশন ভাঙতে হয়। ম্যাকালামকে বাদ দিতে হয়। হয়তো তা-ই হবে। বিসলা ওপেন করবেন গম্ভীরের সঙ্গে। আর যদি দেশি খেলানো হয়, সহবাগের ওই সানি গুপ্ত কেস হয়ে যেতে পারে!
|
মুখোমুখি কলকাতা চেন্নাই |
২০০৮
১। সিএসকে জেতে ৯ উইকেটে (চেন্নাই)
২। সিএসকে জেতে ৩ রানে ডাকওয়ার্থ-লুইস, (কলকাতা)
|
২০১০
১। সিএসকে জেতে ৫৫ রানে (কলকাতা)
২। সিএসকে জেতে ৯ উইকেটে (চেন্নাই) |
২০০৯
১। বৃষ্টির জন্য বাতিল (কেপটাউন)
২। কেকেআর জেতে ৭ উইকেটে (সেঞ্চুরিয়ান) |
২০১১
১। সিএসকে জেতে ২ রানে (চেন্নাই)
২। কেকেআর জেতে ১০ রানে ডাকওয়ার্থ-লুইস, (কলকাতা) |
২০১২
১। কেকেআর জেতে ৫ উইকেটে (চেন্নাই)
২। সিএসকে জেতে ৫ উইকেটে (কলকাতা)
|
|
দিল্লি চারটে বিশাল ট্যাকটিক্যাল ভুল করায় ভারতীয় অধিনায়কত্বে ধোনির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সহবাগকে অন্তত ছ’মাস পিছিয়ে দিয়েছে। এমনিতে এ বারের আইপিএলে যাঁরা খেললেন, তাঁদের মধ্যে গিলক্রিস্ট বাদ দিয়ে বাকি সাত অধিনায়কই কোনও না কোনও আক্রোশে সিএসকের সঙ্গে ধোনিকে হারাতে চেয়েছেন। সহবাগ যদি এই প্রতিহিংসার শপথে ‘শোলে’-র বীরু হন, তা হলে তাঁর দোসর ‘জয়’ হলেন গম্ভীর। টি-টোয়েন্টি এবং বিশ্বকাপ দুটো ফাইনালে ধোনিকে বলতে গেলে একা টেনেছেন গম্ভীর। তা সত্ত্বেও যে তাঁর সহ-অধিনায়কত্ব সম্প্রতি চলে গিয়েছে সিএসকে লবির মদতেই, সেটা গম্ভীরের চেয়ে ভাল আর কে জানে? কেকেআর ক্যাপ্টেন হিসেবে কলকাতার জামাইকে রোববার রাতে তিনি অবশ্যই জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খাওয়াতে চাইবেন না। দলে গৌতম গম্ভীরের কমিটেড ভোটার হিসেবে প্রসিদ্ধ নন মনোজ তিওয়ারি। কিন্তু তিনিও নিশ্চিত, “দিল্লি যা ভুল করেছে, সেই ভুল আমাদের ক্যাপ্টেন জীবনেও করবে না!”
এ বার দেখা যাক, সহবাগ কী কী ভুল করেছেন?
টস জিতে আহাম্মকের মতো ফিল্ডিং করেছেন। টিমের কর্তাদের বলেছেন, এ বারই রান তাড়া করে আমরা গোটা দশেক ম্যাচ জিতেছি। মানতে চাননি গ্রুপ লিগের ম্যাচে আর নক আউট ম্যাচে তাড়া এক জিনিস নয়।
সহবাগকে ওপেন করতে দেখলে বিপক্ষ দলের ঠকঠকানি ধরে, তিনি কি না তিন নম্বরে! কেন? না দক্ষিণ আফ্রিকায় আইপিএলের কোন ম্যাচে তিন নম্বরে নেমে রান করেছিলেন। এই ভুলও গম্ভীর করবেন না। তিনি ওপেনই করবেন।
মর্নি মর্কেলকে দলে না রাখা নিয়ে যে বিস্ফোরণ হচ্ছে, তার পিছনেও সহবাগের যুক্তি, ইরফান খেলতে না পারায় ব্যাটিংটা কমজোরি হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে আন্দ্রে রাসেলকে খেলাতে হয়, যে ব্যাটটাও করতে পারে। এই জায়গাটাই গম্ভীরের পরীক্ষা, বালাজির অভাব তিনি কতটা বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে মেরামত করতে পারেন।
সুইডদের দেশের ক্লে কোর্ট আর চেন্নাইয়ের স্পিনিং ট্র্যাক সমার্থক। অতিথির কাছে একই রকম বিপজ্জনক। এ বার নয়। সুনীল নারিনের সামনে ঝুঁকি নিতে চায় না সিএসকে। উইকেট বদলে ফেলার সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে। নকআউট পর্বে পিচের দায়িত্ব বোর্ডের গ্রাউন্ডস কমিটির হাতে থাকে। তখন আর ফ্র্যাঞ্চাইজি খবরদারি করতে পারে না। কিন্তু সেটা কাগজে-কলমে। বাস্তবে নারিন যাতে ডিজাইনার উইকেট না পান, তার সব চেষ্টা হচ্ছে। ব্যাটিং উইকেট হচ্ছে। এতে কোনও এক অশ্বিনের যাত্রাভঙ্গ হলে সিএসকের সমস্যা নেই।
ওজনে-ভারসাম্যে মিডল অর্ডারে স্ট্রাইক রেট, আইপিএল বংশগৌরবে দু’টো দলের তুলনাই হয় না। নাইটদের হাতে থাকা অঙ্ক বলতে তিনটে। এক, সুনীল নারিন। দুই, গৌতম গম্ভীর। তিন, তাদের কেউ পাত্তা না দেওয়ায় যথেষ্ট চাপ না থাকা।
শাহরুখ খান মুম্বই থেকে এসে পড়ছেন রবিবার সকালে। এ বার নাকি তাঁর সঙ্গে কিছু তারকাও আসছেন। ইন্টারেস্টিং একটা নাম... যা ভাবছেন, নয়। কোনও গসিপ নেই। সম্ভাব্য এক সঙ্গীর নাম রীতেশ দেশমুখ! যাঁর বাবার নেতৃত্বাধীন কমিটি দিন কয়েক আগে ওয়াংখেড়ে থেকে তাঁকে পাঁচ বছরের নির্বাসন দিয়েছে।
এমনই চমক কি বাইশ গজেও অপেক্ষা করবে? চেন্নাই বাদে গোটা ভারতীয় ভূখণ্ড কিন্তু কাল কলকাতার হয়ে চেঁচাবে। তারাও চাইছে নতুন চ্যাম্পিয়ন। আইপিএলে যা একচেটিয়া কারবারের অবসান ঘটাবে। আর মিথ ভাঙবে ওই হলুদ জার্সির। করলাম, লড়লাম, চেন্নাইতেও জিতে গেলাম রে!
|
দুই দাওয়াই |
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
(প্রাক্তন ক্যাপ্টেন) |
ডব্লিউ ভি রামন
(বাংলার কোচ) |
• কালিসকে পরে বল দিক। প্রথম ৬ ওভারে ও বেশি রান দেয়।
• বালাজি ফিট না হলে ব্রেট লি খেলুক। তা হলে সাকিবের বদলে আসুক মনোজ।
• নতুন বলেই চেন্নাই ওপেনারদের অন্তত এক জনের উইকেট নিতে হবে।
• ইউসুফ-লক্ষ্মীর ফর্মকে কাজে লাগিয়ে মাঝের ওভারে রানের গতি বাড়াতে হবে।
• আগে ব্যাট করলে অবশ্যই সুবিধা পাবে গম্ভীররা। |
• কেকেআর মিডল অর্ডারে বিস্ফোরক ইনিংস চাই।
• চেন্নাই মিডল অর্ডারে তিন মারকুটে ধোনি, ব্র্যাভো, রায়নাকে থামাতে হবে।
• নাইটদের ভাল ফিল্ডিংও চাই।
• চেন্নাইয়ে বহু বিগ হিটার। ওরা দ্রুত সিঙ্গলসও নেয়। তাই ক্যাচ, রান আউটের সুযোগ মিলবে।
• ব্রেট লি খেললে বাদ সাকিব না ম্যাকালাম, পিচ বুঝে সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়া চাই। |
|
|
|
|
|
|