গরমের ছুটিতে সপরিবার বেড়াতে যাবেন ভাবছেন? তিন মাস আগে শিয়ালদহগামী রাজধানী এক্সপ্রেসের বাতানুকূল তৃতীয় শ্রেণির টিকিট কাটলেও তা ওয়েটিং লিস্টে থাকায় একটু দুশ্চিন্তা রয়েছে। তবে আশা এই যে, শেষ মুহূর্তে ‘কনফার্ম’ হয়ে যাবে। যেমন আগেও একাধিক বার হয়েছে। কিন্তু এ বারে স্টেশনে গিয়ে দেখলেন, হল না!
নিছক আশঙ্কা নয়। বাস্তবে গত ক’দিন ধরে শিয়ালদহগামী রাজধানীর বাতানুকূল তৃতীয় শ্রেণিতে এটাই ঘটছে। আজ, শনিবার শিয়ালদহগামী রাজধানী এক্সপ্রেসে তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পরে দেখা যায়, প্রতীক্ষা তালিকায় থাকা প্রায় ১৭০ জন যাত্রী জায়গা পাননি। গত কাল, অর্থাৎ শুক্রবারও একই ঘটনা ঘটেছিল। তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পরে প্রতীক্ষা তালিকায় থাকা প্রায় ১৮০ জন জায়গা পাননি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন শিয়ালদহগামী রাজধানীর বাতানুকূল তৃতীয় শ্রেণির প্রতীক্ষা তালিকায় থাকা এত লোক আসন পাচ্ছেন না? অথচ আগেও একাধিক বার এমন অবস্থায় রেল বাড়তি কামরা জুড়ে পরিস্থিতি সামলেছে। এ বারে কেন হল না?
উত্তরটা খুঁজছেন রেল কর্তারাই। রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর, গত দু’দিনই শেষ মুহূর্তে প্রতীক্ষা তালিকার যাত্রীদের কথা ভেবে একটি অতিরিক্ত কামরা জোড়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু দু’দিনই ব্যর্থ হয় মন্ত্রক। জানা যায়, একটি অতিরিক্ত কামরা ইতিমধ্যেই জোড়া রয়েছে ওই ট্রেনে। আরও একটি কামরা জুড়লে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। ফলে আর কোনও অতিরিক্ত কামরা জোড়া যায়নি ওই ট্রেনে।
কিন্তু কোথা থেকে এল ওই অতিরিক্ত কামরা?
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শিয়ালদহগামী রাজধানী এক্সপ্রেসের গোটা একটি কামরা একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থাকে লিজ-এ দিয়েছে পূর্ব রেল। যারা ওই কামরা লিজ নিয়ে নিজেরাই কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে! অভিযোগ, যার কাছে যেমন পারছে, টাকা আদায় করছে ওই সংস্থাটি। তাই প্রতীক্ষাসূচির যাত্রীদের জন্য অতিরিক্ত কামরা জুড়তে ব্যর্থ হয়েছে মন্ত্রক।
রাজধানীর মতো ট্রেনে কারা ভাড়া করছে ওই কামরাটি? গ্রীষ্মাবকাশে যখন টিকিটের এত চাহিদা, তখন রেলই বা কেন এমন অনুমতি দিয়েছে? রেল ভবন সূত্রে বলা হচ্ছে, নামে ভ্রমণ সংস্থা হলেও তা বেনামে চালানোর অভিযোগ শিয়ালদহ শাখারই এক টিকিট পরীক্ষক ও পূর্ব রেলের সদর দফতরের কিছু অফিসারের বিরুদ্ধে। মন্ত্রকের দাবি, যাঁরা নিজেদের প্রভাব ও রেলের নিয়মকে কাজে লাগিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে সামনে রেখে শুরু করেছেন ওই ব্যবসা।
রেলের নিয়ম কী বলছে?
যদিও রেলের ‘ফুল ট্যারিফ রেট’ (এফটিআর)-নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে, শিক্ষামূলক ভ্রমণ বা রাজনৈতিক সমাবেশ যোগ দেওয়ার জন্য গোটা একটি কামরা ভাড়া নিতে পারেন যে কোনও ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কোনও রাজনৈতিক দল। নিয়ম এ-ও বলছে, কোনও ভ্রমণ সংস্থা চাইলে নিয়মিত ভিত্তিতে একটি কামরা ভাড়া নিতেই পারেন। সেই উদাহরণও রয়েছে। মন্ত্রকের বক্তব্য, বছর দেড়-দুই ধরে পদাতিক এক্সপ্রেসের একটি কামরা ভাড়া নিয়ে এই ধাঁচে ব্যবসা করছে একটি ভ্রমণ সংস্থা। রাজধানীর ক্ষেত্রেও ওই সংস্থাটি যে নিয়ম মেনেই কামরা সংরক্ষণ করেছে, তা মেনে নেন পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী।
তবে রেল কর্তারা জানাচ্ছেন রাজধানীর মতো ট্রেনের সময়-অসময় বিবেচনা না করে এ ভাবে কামরা ভাড়া দেওয়া যায় না। কেন না কোনও ট্রেনের গোটা একটি কামরা ভাড়া দেওয়ার আগে বেশ কয়েকটি বিষয় দেখতে হয় মন্ত্রক বা সংশ্লিষ্ট জোনকে। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “ট্রেনটির গুরুত্ব, টিকিটের চাহিদা ও বিশেষ করে কোন সময়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হয়। বড়দিনের, গ্রীষ্ম বা পুজোর ছুটির সময়ে এই ধরনের ভাড়া দেওয়া বন্ধ থাকে। তা ছাড়া রাজধানীর কামরা ভাড়া দেওয়ার কোনও নজির সম্ভবত নেই।” মন্ত্রকের ধারণা, এ ক্ষেত্রে সংস্থাটিকে লিজ পাইয়ে দিতে নিয়মকে উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মন্ত্রক জেনেছে, এক টিকিট পরীক্ষক ও পূর্ব রেলের কমার্শিয়াল দফতরের কিছু কর্মীর যোগসাজশেই চক্রটি রমরম করে চলছে। রেলের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন অভিযুক্ত কর্মীরা।
রেল মন্ত্রকের কর্তাদের অভিযোগ, মুনাফার লক্ষ্যেই কামরা ভাড়া নেওয়ার জন্য বাছা হয়েছে গরমের ছুটির এই সময়কে। স্কুল-কলেজ বা আদালতগুলিতে ছুটি পড়ে যাওয়ায় টিকিটের চাহিদা এখন তুঙ্গে। এ সময় একটা বড় অংশের যাত্রীর মধ্যেই যে কোনও দামে টিকিট কেটে গন্তব্যে পৌঁছনোর প্রবণতা থাকে। এগুলিকেই মূলধন করে সংস্থাটি ছুটির মরসুমকে বেছে নিয়েছে। পূর্ব রেল সূত্রের খবর, শিয়ালদহ রাজধানীতে ১৮ মে থেকে অতিরিক্ত কামরাটি জোড়া হচ্ছে। যদিও পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামীর দাবি, “মাত্র চার দিনের জন্য ওই কামরা চাওয়া হয়েছিল।” ত বে মন্ত্রকের দাবি, বাড়তি কামরাটি গত চার দিন ধরে নয়, গত সাত দিন ধরে জোড়া হয়েছে শিয়ালদহ রাজধানীতে। তাই প্রতীক্ষা তালিকায় বেশি যাত্রী থাকলে অতিরিক্ত কামরা লাগিয়ে যে সুরাহা রেল মন্ত্রক এত দিন দিত, তা দেওয়া যাচ্ছে না। রেল কর্তাদের আশঙ্কা, শিয়ালদহ রাজধানীর পরে এ বার হাওড়া রাজধানীরও একটি কামরা সংস্থাটিকে লিজে পাইয়ে দিতে সক্রিয় ওই চক্রটি।
কিন্তু এ ভাবে কামরা ভাড়া দিয়ে কত লাভ হচ্ছে রেলের? মন্ত্রকের উত্তর, খুব সামান্য। কারণ ওই সংস্থা ‘ফুল ট্যারিফ রেট’ দিয়ে ৭২টি আসন নির্দিষ্ট ভাড়ায় কিনে নিচ্ছে। বাড়তি হিসেবে আরও ১৫ শতাংশ পরিষেবা কর দিচ্ছে তারা। ওই ১৫ শতাংশ বাড়তি অর্থই রেলের লাভ। অথচ এমন চক্রে কর্মীদের নাম জড়ানোয় বদনামের ভাগ নিতে হচ্ছে গোটা রেল মন্ত্রককে।
কতটা লাভ করছে ওই সংস্থাটি? অভিযোগ, ওই ভ্রমণ সংস্থাটি রাজধানীর বাতানুকূল তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ১৫৩৫ টাকার বদলে বিক্রি করছে দ্বিগুণেরও বেশি দামে। দিল্লির পাহাড়গঞ্জ এবং শিলিগুড়ি ও শিয়ালদহে ওই সংস্থার দফতর থেকে ২৭০০-৩৫০০ টাকায় ওই টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। এবং হাতে হাতে পাওয়া যাচ্ছে ‘কনফার্ম’ টিকিটও! এক একটি কামরা লিজ নিয়ে তারা একটি যাত্রায় দিনে দেড় থেকে দু’ লক্ষ টাকা মুনাফা করছে বলেও অভিযোগ। যার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা।
কিন্তু এত বেশি দাম কি যাত্রীদের থেকে নিতে পারে সংস্থাটি? মন্ত্রকের বক্তব্য, যাত্রী পরিবেষার জন্য কিছু বাড়তি অর্থ দাবি করলেও তা কখনই দ্বিগুণ দাম হতে পারে না। সমীরবাবুর বক্তব্যও একই। মন্ত্রক কর্তাদের বক্তব্য, জনস্বার্থের কথা বলে রেলমন্ত্রীরা টিকিটের ভাড়া বাড়াচ্ছেন না, অথচ, এক্ষেত্রে বেশি ভাড়ায় যেতে হচ্ছে যাত্রীদের। এবং সেই সুবিধা তারাই পাচ্ছেন, যাঁদের বেশি দামে টিকিট কেনার ক্ষমতা আছে। রেলমন্ত্রী মুকুল রায় রাতে বলেন, “অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখব। কোনও অনিয়ম পাওয়া গেলে দোষীদের শাস্তি হবে।” সমীরবাবু বলেন, “মূলত দু’টি অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। প্রথমত, যাত্রীদের থেকে অনেক বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রেলের কিছু কর্মীর জড়িত থাকা। অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখব।” রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল দিল্লির বাইরে। মন্ত্রক সূত্রের খবর, তিনি ফিরলেই বিষয়টি তাঁকে জানানো হবে। তার পরেই পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।
|