সবুজ পর্দার সামনে থমকে গিয়েছে ভিড়টা। কনুই মেরে চলছে এ-ওকে ঠেলা দেওয়া— “তুই যা না!” “তুমিই যাও না কেন!”
মলিন পাৎলুন, খয়াটে লুঙ্গি, ছেঁড়া হাফ-প্যান্ট, মুখে খোঁচা দাড়ি, সবুজ পর্দা ঠেলতে সাহস পায় না। “স্যার আসব?”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মহকুমাশাসক। “আরে আপনাদের জন্যই তো বসে আছি, আসুন, আসুন...”। আমলার চওড়া হাসিতে ঘাম দিয়ে জ্বর নামে ওঁদের। গদি আঁটা চেয়ারে জড়সড় ভাবে একে-একে বসেন। তেহট্টের মহকুমাশাসক অচিন্ত্য মণ্ডল চায়ের অর্ডার দেন। খাতিরের ‘বহর’ দেখে শুরু হয় ফিসফাস, ‘‘এখান থেকেই অ্যারেস্ট করবে না তো!’’ অচিন্ত্যবাবু অবশ্য সে বান্দা নন। বরং মিঞাপুরের (নাম পরিবর্তিত) বাসিন্দাদের কাঁচুমাচু মুখগুলোর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “কি, সকলের দুধ চা চলবে তো!” তারপরে শুরু করেন ‘বৈঠক’।
কীসের বৈঠক?
|
অচিন্ত্য মণ্ডল |
মাস আটেক ধরে বড় বেকাদায় পড়েছে নদিয়ার ওই মহকুমা সদর। শ’খানেক সাইকেল, খান তিরিশেক জেনারেটর, রাস্তার আলো‘উধাও’। খোদ মহকুমাশাসকের দফতর থেকেই এক মাসে চুরি গিয়েছে দু’-দু’টি জেনারেটর। পুলিশ? অচিন্ত্যবাবু বলেন, “অভিযোগ হচ্ছে, কিন্তু কিনারা কোথায়!”
দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিলেন মহকুমাশাসক। দফতরের জনাকয়েক কর্মীকে দিয়ে আশপাশের গ্রামে রীতিমতো ‘গোয়েন্দাগিরি’ চালিয়ে খোঁজ পেয়েছিলেন ‘নাটের গুরু’দের সংখ্যাগুরুর ঠিকানা স্থানীয় একটি গ্রাম। অচিন্ত্যবাবু বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে সাইকেলে, পায়ে হেঁটে গাঁ-গঞ্জ ঘুরেছি আমরা। জানতে পারি, তেহট্টের একটি নির্দিষ্ট গ্রামের কিছু লোকজন এই নিত্য চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত। স্থানীয় থানার কেস-ডায়েরি ঘেঁটে দেখি, পুলিশের খাতায় তাঁদের অনেকেরই নাম রয়েছে। সিদ্ধান্ত নিই, ওঁদের এক বার ডেকে, একটা আলোচনা করলে কেমন হয়!”
ঝিকু দফাদার, আনওয়ার মণ্ডলদের (নাম পরিবর্তিত) মতো জনা বারোকে ‘পেশা’ বদলের একটা সুযোগ দিতে শুক্রবার রীতিমতো সরকারি চিঠি পাঠিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন অচিন্ত্যবাবু।
বৈঠকে এসডিপিও (তেহট্ট) মলয় মজুমদার কিংবা থানার আইসি দেবপ্রসাদ পৌরাণিকেরও ‘আমন্ত্রণ’ ছিল। তবে আসেননি তাঁরা।
কেন?
মলয়বাবু বলেন, ‘‘অচিন্ত্যবাবুর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল বৈঠকে, কিন্তু এ দিন দুপুরেই পুলিশ সুপার এলাকা পরিদর্শনে আসায় ওখানে আর যাওয়া হল না।” তাঁর দাবি, সাম্প্রতিক চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় তেহট্টের ওই গ্রামের কিছু লোকের উপরে পুলিশ ‘নজর’ রাখছিল। কিন্তু গত আট মাসে, অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশের খাতায় নাম থাকলেও তেহট্ট থানা তাঁদের ধরল না কেন? দেবপ্রসাদবাবু বলেন, ‘‘তক্কে-তক্কে ছিলাম। ঠিকঠাক খোঁজ পেলেই ধরতাম।”
পুলিশ ‘ঠিকঠাক খোঁজ’ না পেলেও অচিন্ত্যবাবু অবশ্য তাঁদের খুঁজে পেয়েছেন। ‘বৈঠকে’ মহকুমাশাসক আশ্বাস দেন, ‘‘পুলিশ ডেকে আপনাদের ধরিয়ে দিতে এখানে ডাকিনি কিন্তু। আপনাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় অভিযোগ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণ করার দায় আপনাদেরই। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করে নিন্দুকদের দেখিয়ে দিন, আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ধারণা সব ভুল। আপনারা নিশ্চয় এটা পারবেন। প্রশাসন আপনাদের সব রকম সাহায্য করবে।’’
প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের ব্যাঙ্ক-ঋণ কিংবা একশো দিনের প্রকল্পে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন মহকুমাশাসক। “কিন্তু আমাদের তো জব কার্ড নেই”, শুনে অচিন্ত্যবাবু বলেন, “সে ব্যর্থতা আমাদের। আমি নিজেই সাত দিনের মধ্যেই কার্ড জোগাড় করে দেব।”
মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চায়ের কাপ তুলে নিয়েছেন আনওয়ারেরা। বলছেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আসলে অভাবই আমাদের ও পথে ঠেলে দিয়েছিল। তবে প্রশাসন পাশে থাকলে আর নয়।”
কিন্তু ‘হারানো’ তৎপরতা প্রমাণ করতে পুলিশ এ বার তাঁদের গ্রেফতার করবে না তো? জিভ কাটেন এসডিপিও, “অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে ওঁদের। গ্রেফতারের প্রশ্ন কোথায়?”
গ্রামে ফেরার আগে মিঞাপুরের ‘আমন্ত্রিতেরাও’ অচিন্ত্যবাবুকে কথা দিয়েছেন, সবুজ পর্দার ওপারে যে ‘সম্মান’ পেয়েছেন, তার অমর্যাদা করবেন না। |