বেলগাছিয়া
অবহেলার শিশু
দুর্গা দাস, দুর্গি রাওদের পাঁচটি করে ছেলেমেয়ে। দু’জনেই ফের সন্তানসম্ভবা। এক জনেরটি সম্প্রতি নষ্ট হয়েছে। অন্য জনকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বার খাদ্য তালিকায় সকালে এক কাপ চা, কখনও বিস্কুট। ছেলে-মেয়ে ভাগাড় থেকে আবর্জনা কুড়িয়ে কিছু পেলে তবেই জুটবে বেলা গড়িয়ে বিকেলের ডাল, ভাত আর আলুর চোখা। এর বেশি কিছু মানে সে দিন খাবারের উৎসব। মাতৃত্বকালীন ও সদ্যোজাতের পরিচর্যার বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা নেই এঁদের। ‘এফ’ রোড, হাওড়া বেলগাছিয়া ভাগাড় বস্তির প্রতি ঘরে থাকেন এমন দুর্গারা। অশিক্ষা আর অপুষ্টি যাঁদের কাছে ‘অসুর’।
মায়ের অপুষ্টির কারণে ঘরে ঘরে জন্মাচ্ছে অপুষ্ট শিশু। ওজন কম-সহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় অকালে মারা যাচ্ছে শিশুরা। কোনও ক্ষেত্রে বয়স বাড়লেও হাঁটতে শিখছে না। ২০১২-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এলাকায় শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ১৩১। সন্তানসম্ভবা ও প্রসূতি মায়ের সংখ্যা ৬২। সম্প্রতি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই সব তথ্য।
হাওড়া পুর এলাকার আট নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এই বসতিতে থাকেন প্রায় ১৩০০ বাসিন্দা। ভাগাড়ের আবর্জনা থেকে জিনিস কুড়িয়ে বিক্রি করাই যাঁদের প্রধান জীবিকা। এ কাজে জড়িয়ে আছেন মহিলা ও শিশুরা। ফলে অপুষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, ডায়েরিয়া, শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা। অসময়ে গর্ভবতী হওয়ার সমস্যা রয়েছে অঞ্চলে। এমনকী, একাধিক সন্তানের জন্ম, অপরিণত শিশুর জন্ম, ওজন কমের সমস্যা-সহ বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগে শিশু ও মায়ের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তা সত্ত্বেও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার, সতর্কতায় এবং গর্ভবতী মা ও শিশুর পরিচর্যায় পরিষেবা দিতে এলাকায় কোনও আইসিডিএস সেন্টার নেই। নেই কোনও প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এলাকাবাসীর দাবি, এই নিয়ে বহু বার অভিযোগ করা হয়েছে প্রশাসনের কছে। এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দূরে কুঞ্জপাড়া হেল্থ সেন্টার। ওখান থেকে এসে শুধু পোলিও খাওয়ানো হয়। বাসিন্দা মণিকা বাঁশফোড়ের অভিযোগ, “পোলিও খাওয়ানো ছাড়া হেল্থ সেন্টারে গিয়ে আর কী সাহায্য পাওয়া যায় তাই আমরা জানি না।” আইসিডিএস সেন্টারের কাজ সম্পর্কেও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই বাসিন্দাদের। এলাকাবাসীর দাবি, এক কিলোমিটার দূরের বামনগাছিতে একটি আইসিডিএস সেন্টার আছে। কিন্তু ওখানে তাদের শিশুদের চাপ থাকে। এখান থেকে শিশুদের নিয়ে গেলে তাই ফেরত পাঠায়।” বাসিন্দা মুনিয়াদেবীর কথায়: “খিচুড়ি খাওয়ার সেন্টার থাকলে বাচ্চাগুলো অন্তত এক বেলা খেতে পারে।’’
বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রসঙ্গে হাওড়ার মেয়র মমতা জয়সওয়ালের বক্তব্য, “ওই জমি নিয়ে বিতর্ক আছে। তা ছাড়া আইসিডিএস সেন্টার খোলা পুরসভার দায়িত্ব নয়।” পুর প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকার প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। হাওড়ার ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “কেন ওখানে আইসিডিএস সেন্টার নেই, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।” এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান গোপালচন্দ্র বৈদ্যের কথায়: “ওখানে আইসিডিএস সেন্টার ও প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে অনেক বার যোগাযোগ করেছি। উত্তর মেলেনি।”
আইসিডিএস সেন্টার খোলার প্রসঙ্গে হাওড়ার ডিপিও (আইসিডিএস) নিতাই বাগ বলেন, “হ্যামলেট (বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা) এলাকায় শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী ২০টি শিশু থাকলেই আইসিডিএস সেন্টার খোলা যায়। ওখানের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। অঙ্গনওয়াড়ি নিয়োগ নিয়ে জটিলতা থাকায় নতুন করে সেন্টার খোলায় সমস্যা হচ্ছে। তবে বিধায়কের প্রস্তাব থাকলে তাড়াতাড়ি অনুমোদন করা হয়।” শিবপুরের তৃণমূল বিধায়ক জটু লাহিড়ী বলেন, “এ বছরের শেষে কয়েকটি সেন্টার খোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। ওই এলাকার কথাও গুরুত্ব সহকারে ভাবা হবে।”
রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের অধিকর্তা প্রমল সামন্তের বক্তব্য, “আইসিডিএস সেন্টারের মূল উদ্দেশ্যই হল ‘কম্যুনিটি পার্টিসিপেশন’। সুতরাং জমি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আইসিডিএস সেন্টারের যাবতীয় পরিষেবা পাওয়ার যোগ্য বাসিন্দারা। সে ক্ষেত্রে বিতর্কিত এলাকার বাইরে সেন্টার গড়ে তোলা যায়। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আগে সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে যোগাযোগ করুক। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।”

ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.