শুধু একটি অভিযোগপত্র ও ‘উড়ো’ ফোন পেয়েই একটি সংস্থার ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার। তার আগে কোনও রকম তদন্ত বা বিশদ খোঁজখবর করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। সংস্থার প্রতিনিধিরা গিয়ে নথিপত্র দেখানোর পরে বুধবার সেই নিষেধাজ্ঞা তিনি তুলে নিয়েছেন।
গত ১৮ মে সুপার অসিতবরণ সামন্ত জানিয়েছিলেন, কয়েক জন হাউসস্টাফ ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি চিকিৎসককে ‘মাসোহারা’ দিয়ে একটি সংস্থা নিজেদের ওষুধ লেখাচ্ছে বলে লিখিত অভিযোগ করেছেন ‘দেবাশিস মিত্র’ নামে এক জন। বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিসিডিএ) থেকে ‘তরুণ দাস’ নামে এক জন টেলিফোনে জানিয়েছেন, ওই সংস্থাকে তাঁরা ওষুধ বিক্রির ‘অনুমোদন’ দেননি। তার ভিত্তিতেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
ঘটনা হল, বিসিডিএ-র কোনও ওষুধ সংস্থাকে কোনও ‘অনুমোদন’ দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। কোনও সংস্থা সরকারি হাসপাতালে সরাসরি ওষুধ সরবরাহও করতে পারে না। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স দরপত্র ডেকে সংস্থা নির্বাচন করে। তাদের থেকে কেনা ওষুধ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স অনুমোদিত সংস্থার থেকে ওষুধ কিনতে পারেন। ওষুধ তৈরি এবং সরবরাহের জন্যও ড্রাগ কন্ট্রোল ছাড়া আর কারও অনুমোদন লাগে না। তারাই লাইসেন্স নবীকরণ করে। সুপার জানিয়েছিলেন, ওই সংস্থাটির এই ‘ড্রাগ লাইসেন্স’ নেই বলেই অভিযোগে জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার সংস্থার অন্যতম কর্ণধার সঞ্জয় মজুমদার ‘ড্রাগ লাইসেন্স’-সহ যাবতীয় নথি নিয়ে সুপারের সঙ্গে দেখা করার পরেই কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এ দিন ফের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সুপার বলেছেন, “আমার কাছে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে আসা যাবতীয় অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণ হয়েছে। তাই ওই সংস্থার বিরুদ্ধে আমার আগের জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।” তাঁর ব্যাখ্যা, “ওঁদের কাগজপত্র দেখে আপাতত আগের নির্দেশ ফিরিয়ে নিলাম। পরে ড্রাগ কন্ট্রোলে চিঠি লিখে জানতে চাইব, ওঁদের সত্যিই যথাযথ অনুমতি আছে কি না।” কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে তিনি কেন ড্রাগ কন্ট্রোলে খোঁজ নেননি, তার সদুত্তর মেলেনি।
সুপার কেন বিসিডিএ-র নামে ফোন পেয়ে তা গ্রাহ্য করলেন, তা-ও স্পষ্ট নয়। সুপারের ব্যাখ্যা, “বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকেরা দফায় দফায় খোঁজ নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে বিসিডিএ-র নামে তরুণ দাস পরিচয় দিয়ে এক জন ফোন করায় আমি ধরে নিই, অভিযোগ সত্যি। তাই দেরি না করে ব্যবস্থা নিই।” অথচ সঞ্জয়বাবুর সঙ্গেই সুপারের কাছে গিয়ে বিসিডিএ-র সভাপতি রণেন্দ্রনারায়ণ রায় বলেন, ‘‘ওষুধ তৈরি বা বিক্রি করতে গেলে আমাদের সংগঠনের অনুমতি লাগে না। তরুণ দাস নামে আমাদের কোনও সদস্যও নেই।”
সঞ্জয়বাবুর দাবি, অভিযোগকারী যে ‘দেবাশিস মিত্র’ নামে নিজের পরিচয় দিয়েছেন, তা-ও ভুয়ো। ওই নামে তাঁদের এক কর্মী আছেন। তাঁদের অপদস্থ করার উদ্দেশ্যেই কেউ ওই নাম ব্যবহার করে সুপারের কাছে অভিযোগ করেছেন। কয়েক দিন আগে জাল নথিপত্র দিয়ে চাকরি করার দায়ে ভাতারের আমারুন থেকে আসা এক কর্মীকে তাঁরা বরখাস্ত করেছেন। সংস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে তিনিই নাম ভাঁড়িয়ে অভিযোগ এবং ‘ভুয়ো’ ফোন করে বা করিয়ে থাকতে পারেন বলে সঞ্জয়বাবুদের আশঙ্কা। বর্ধমান থানায় তাঁরা লিখিত ভাবে সে কথা জানিয়েওছেন। পুলিশ জানায়, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের নির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে, সরকারি চিকিৎসকেরা কোনও সংস্থারই ওষুধের নাম লিখতে পারবেন না। প্রেসক্রিপশনে ওষুধের রাসায়নিক (জেনেরিক) নাম লিখতে হবে। ফলে, কোনও সংস্থার ওষুধের নামই যেখানে লেখার কথা নয়, সুপার কেন একটি নির্দিষ্ট সংস্থার ওষুধ লিখতে নিষেধ করলেন, সে প্রশ্নও উঠেছে। সুপারের বক্তব্য, “জেনারিক নাম লেখার এখনও তেমন প্রচলন নেই। সব চিকিৎসকই প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লেখেন।”
বস্তুত, রাজ্যে বহু হাসপাতালেই ‘জেনেরিক’ নাম লেখা এখনও চালু করা যায়নি। সেই সুযোগে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভরা বিভিন্ন উপঢৌকন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট সংস্থার ওষুধ লিখতে প্রভাবিত করছেন এই অভিযোগও দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। বর্ধমান মেডিক্যালের ঘটনায় সেই অভিযোগ তো ফের উস্কে উঠেছেই, যথাযথ তদন্ত ছাড়া কী করে নির্দেশ জারি হতে পারে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি। |