মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং অনন্ত চাপের ম্যাচ! দু’টো এক জায়গায় হল মানে অবধারিত ভাবে ফুল্কি ছুটবে! বুধবার বেঙ্গালুরুর মাঠে আবার দেখে নেওয়া গেল। ব্যাট হাতে ২০ বলে ৫১ আর কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর বিখ্যাত বরফ-শীতল মস্তিষ্ক চালিয়ে ধোনি আইপিএলে টিঁকিয়ে রাখলেন চেন্নাই সুপার কিংসকে। ছিটকে গেল সচিন তেন্ডুলকরের মুম্বই। সেই সঙ্গে কলকাতা নাইট রাইডার্সের সামনে এই কাঁটাটাও থেকে গেল যে, ফাইনালে ধোনির চেন্নাইকে না চেন্নাইতে খেলতে হয়। আর কে না জানে ফাইনালে ধোনির রেকর্ড! ধোনিদের অবশ্য ফাইনালে যাওয়ার জন্য আগে সহবাগদের হারাতে হবে। |
রাতের চিন্নাস্বামীতে ধোনির টিমকে এক ঝাঁক হলুদ পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে দেখে আবার মনে হচ্ছে, অলক্ষ্যে হয়তো এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ কিছুর সাক্ষী এ দিন হয়ে থাকল রাহুল দ্রাবিড়ের ঘরের মাঠ। যখন ডোয়েন স্মিথকে রক্ষা করে নিজের উইকেট ত্যাগ করে দিয়ে গেলেন সচিন তেন্ডুলকর। বরাবর অন্য ব্যাটসম্যানরা উইকেট ত্যাগ করে দিয়ে গিয়েছেন তাঁকে রক্ষা করার জন্য। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পাকেচক্রে আজ উল্টোটা দেখা গেল। স্মিথ তখন টপ গিয়ারে চলছেন। সচিন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। স্মিথ ততক্ষণে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছেন হতাশায়। ডাগ-আউটের দিকে রওনা হওয়ার সময় স্মিথকে কিছু একটা বলে গেলেন সচিন। সম্ভবত সান্ত্বনা দিয়ে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করলেন যাতে ১৮৮ তাড়া করার অভিযানটা ঠিকঠাক থাকে। ও দিকে সচিন বেরিয়ে যাচ্ছেন, প্রেসবক্সের পাশের গ্যালারিতে এক প্রবীণ দর্শক মন্তব্য করলেন, “সনিয়া গাঁধীর প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার মতো! অবিশ্বাস্য!”
বিরল সেই দৃশ্যও যে ট্র্যাজিক দৃশ্য হয়ে থাকবে কে জানত! স্মিথ ৮ রানের মধ্যে তিনি ফিরে গেলেন আর দ্রুত চিন্নাস্বামীর দখল নিয়ে ফেললেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’! ১৫ ওভারের মধ্যে সাত উইকেট হারিয়ে মুম্বই একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। মুম্বই অধিনায়ক হরভজন সিংহকে ফিরতে হল বিধ্বস্ত হয়ে। ৩৮ রানে হেরে পঞ্চম আইপিএলের গ্রহ থেকে ছিটকে তো গেলেনই, উল্টে ব্যাট করতে এসে প্রথম বলেই ডোয়েন ব্র্যাভোর বাউন্সার আছড়ে পড়ল হেলমেটে। শেষ চার ওভার যখন শুরু হচ্ছে, মুম্বইয়ের দরকার ৬১। হাতে তিন উইকেট। অলৌকিক কিছু না ঘটলে কায়রন পোলার্ড থাকলেও যে ম্যাচ আসবে না তখনই বোঝা যাচ্ছিল।
পোলার্ড আউট হওয়ার সময় মুম্বই ডাগ-আউটে হরভজনের বিষণ্ণ চোখমুখ দেখতে দেখতে বিস্ময়করই লাগছিল। একটা টিম অন্যতম ফেভারিট হিসেবে কোয়ালিফায়ার্সে পৌঁছল। আর একটা ছিটকে যেতে যেতে ভাগ্যের বরাত পেয়ে শেষ চারে উঠে তাদের ছিটকে দিল। বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছে, ধোনির চেন্নাই না এখান থেকে ট্রফি নিয়ে চলে যায়! |
আরও মনে হচ্ছে, মুম্বইয়ের বিদায়ে সচিন তেন্ডুলকর না আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দুনিয়া। নির্মম দুনিয়া। ব্যর্থ হলে কাউকে প্রশ্ন করতে ছাড়ে না। সচিন কি একমাত্র ব্যতিক্রমী হিসেবে প্রশ্নের উর্ধ্বে থাকতে পারবেন? মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের মধ্যে কথা হচ্ছিল ওপেনিং নিয়ে। আট-ন’টা ওপেনিং জুটি চেষ্টা করা হয়েছে। তাতেও শুরুর দিককার স্ট্রাইক রেট ভাল হয়নি। আজকের ম্যাচটাই ব্যতিক্রম মনে হচ্ছিল। সচিন আর স্মিথ পাঁচ ওভারের মধ্যে ৪৫-এর ওপর তুলে ফেলেছিলেন। আর আজই কি না ভাগ্যে রান আউটের বিধান লেখা ছিল!
সচিনের বড় ইনিংস দেখা হল না। বেঙ্গালুরু দেখল মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে। এ দিন ব্যাট করতে যাওয়ার আগে চেন্নাই সুপার কিংস অধিনায়কের আইপিএল অভিযান নিয়ে বলার মতো প্রায় কিছুই পড়ে ছিল না। কোনও কোনও ম্যাচে এমনকী ১০০ স্ট্রাইক রেটও রাখতে পারেননি। কিন্তু আজ যে হাতে সবচেয়ে প্রিয় প্রশ্নপত্র। কঠিনতম পরিস্থিতিতে বাজি জিতে বেরিয়ে যাওয়া তাঁর চেয়ে সফল ভাবে আর কে করে দেখাতে পেরেছে? ২ এপ্রিল, ২০১১-র ওয়াংখেড়েতে ১১৪-৩ থেকে ভারতকে কাপ জয়ের রাস্তা দেখিয়েছিলেন। এ দিন বেঙ্গালুরুতে যখন ব্যাট হাতে নামছেন, তখন চেন্নাই ১৩.২ ওভারে ৯৫-৩। শুরুতে ধবল কুলকার্নি পরপর দু’বলে মুরলী বিজয় আর সুরেশ রায়নাকে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে মাইকেল হাসি এবং বদ্রিনাথ ৯৪ রান যোগ করে মোটামুটি ভদ্রস্থ একটা মঞ্চ তৈরি করেছেন। কিন্তু জেতার মতো রান তখনও ওঠা বাকি। সেই পরিস্থিতিতে ধোনির আগমন এবং ২ এপ্রিল ওয়াংখেড়ের মতোই বাজিগর হয়ে ফেরা। তাঁর সেই বিখ্যাত হেলিকপ্টার শট বের করলেন। চলতি আইপিএলে যা দেখাই যায়নি।
আর কাকে মারলেন? না, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে কৃপণ এবং সফল বোলার লাসিথ মালিঙ্গাকে। কোথায় মারলেন? না, বেঙ্গালুরুর মাঠে যেখানে এক প্রকার ভিলেন হিসেবেই তাঁদের দেখা হচ্ছিল। যেহেতু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ছিটকে গিয়েছে আর চেন্নাই সুপার কিংস শেষ চারে উঠেছে। ধোনি বেঙ্গালুরুর জনতাকেও তাঁর দিকে টেনে নিলেন। দু’টো ছয়ের একটা মালিঙ্গাকে হেলিকপ্টার শট। অন্যটা ফেললেন গ্যালারির ছাদে। এখন পর্যন্ত আইপিএলে মারা সবথেকে লম্বা ছয়। ক্রিস গেইলের মাঠে গেইলের রেকর্ড ভেঙে দিলেন। তাঁর সঙ্গে ডোয়েন ব্র্যাভো। ধোনি যেমন হেলিকপ্টার শট মারলেন তেমন তিনি অফস্টাম্পের ওপর থেকে প্রায় পাখির মতো উড়ে গিয়ে ছয় মারলেন কভারের ওপর দিয়ে।
রকমারি সেই সব শটের ফুলঝুরি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এত কাল আইপিএলে ক্রিকেটের রক্ষাকর্তা বলা হত বিনোদনকে। এখন বিনোদন কাঠগড়ায়। রক্ষাকর্তার নাম ক্রিকেট!
|