প্রখর বাস্তব হল এই যে ভ্রমণপুস্তিকা অনুযায়ী পুণে শহরটাকে এখন আর পেনশনারদের সুখী উপত্যকা বলার উপায় নেই। বরং শহরের নতুন প্রজন্ম এবং আইটি তরুণরা নিয়মিত দাবি জানাচ্ছে, ভ্রমণপুস্তিকা সংশোধিত হোক। পুণে অভিহিত হোক তরুণদের সুখী শহর হিসেবে।
তেমনই প্রখর বাস্তব হল, এই কেকেআরের গুরু এখন তিনি। কোচ ট্রেভর বেলিসকে ভুলে যান। তিনি সৌরভের আমলের জন রাইট। এমনকী প্রবল পরাক্রান্ত মালিককেও ভুলে যান। ক্রিকেটীয় চৌহদ্দিতে গুরুই প্রথম ও শেষ কণ্ঠস্বর।
একই সঙ্গে তিনি গম্ভীর। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রীর মতো কম হাসেন বললে যদি তরুণ টি-টোয়েন্টি প্রজন্মের বুঝতে সমস্যা হয়, তা হলে সহজতর রাস্তায় ব্যাখ্যা হতে পারে। চলতি আইপিএলে যাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ১৪২, গত কালের ইনিংসের স্ট্রাইক রেট আবার ২০০। ডট বল তাঁর জীবনে যেমন দুষ্প্রাপ্য ঘটনা, তেমনই হাসিও। হাইটটা নেহাত কম। পাঁচ ফুট সামান্য কিছু হবে। যদি রবি শাস্ত্রীর উচ্চতার হতেন তা হলে ড্রেসিংরুমে এত দিনে নির্ঘাত নামকরণ হয়ে যেত ‘বাচ’। কারণ তিনি গম্ভীর এবং সামান্য প্ররোচনায় রাগী, তেজস্বী তরুণও।
পুণে ম্যারিয়টের কফি লাউঞ্জের বাইরেটায় বসে বুধবার অবশ্য তিনি সামান্য হাসছেন। তাঁর কথাবার্তা শুনলে আর কিছু ক্ষণ সময় কাটালে প্রথম প্রশ্ন হবে: এই মানুষটা ধোনির ডেপুটি হয়ে এত দিন ছিল কী করে? প্রকৃতিগত এত তফাত যে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যদি সুয়েজ ক্যানাল হন, গৌতম গম্ভীর তা হলে আদি অকৃত্রিম গঙ্গা। মঙ্গলবার বিস্ফোরক ব্যাটিং এবং অধিনায়কত্বে কেকেআর-কে প্রথম আইপিএল ফাইনালে তুলে দেওয়ার পর ভারতীয় ক্রিকেট অলিন্দে গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে, আগামী ২৭ মে যদি শ্রীনিবাসনের নাকের ডগায় তিনি আইপিএল ট্রফি ছিনিয়ে নেন, শুধু ট্রফি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা যথার্থ হবে না। অবিলম্বে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া উচিত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় অধিনায়কত্বের মুকুট। |
• তাজা মস্তিষ্ক আর নতুন দর্শন।
• টিম ভ্যালুজ ফিরিয়ে আনতে পারবেন। যা ধোনির জমানায় বহু দিন অদৃশ্য।
• দায়ভার নেবেন দলের পারফরম্যান্সের। ০-৮ হেরে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকবেন না।
• নিজে ভুল করে ফেললে অসঙ্কোচে ক্ষমাপ্রার্থী হবেন নিজেই। ছোট-বড় তারতম্য না করে।
মঙ্গলবার মাঝরাতে যখন শাহরুখ খান মাঠে ডিগবাজি খাচ্ছেন, যখন ক্রিকেট পৃথিবী মুগ্ধ হয়ে কেকেআর ক্যাপ্টেনকে তারিফ করছে, সেই সময় কেকেআর ড্রেসিংরুমে ম্যাচের বাইরের গভীরতম মুহূর্ত তৈরি হয়। যখন লক্ষ্মীরতন শুক্লকে এক কোণে ডেকে নিয়ে যান গম্ভীর। বলেন, “লক্ষ্মী, সরি। আগের ম্যাচগুলোয় আমার তোমাকে আরও ব্যাটিংয়ের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।” এ দিন নিজেই সেই প্রসঙ্গ তুলে বলেন, “লক্ষ্মীর ব্যাটিং দক্ষতা মাপতে ভুল করেছিলাম মেনে নিতে লজ্জা নেই।” একই সঙ্গে তিনি আবার টিমের সুপারস্টারকে অক্লেশে বলে দিতে পারেন, টিমের নিয়ম মানো। নইলে সোজা অস্ট্রেলিয়ার বিমানে ওঠো। ক্রিকেটারের নাম ব্রেট লি। মাঝদুপুরে পুণের ঝকঝকে আকাশের তলায় বসে ব্রেট লি প্রসঙ্গ উঠলে হালকা সিঙ্গলস নিয়ে যেন গম্ভীর চলে যেতে চান অন্য প্রান্তে। তবে ডট বল খেলেন না। বলেন, “কে কোন দরের, কে বড় কে নিচু, প্লেয়ার-শৃঙ্খলা তার ওপর নির্ভর করে না। তবে ব্রেটের ব্যাপারটা বলি, এক সংসারে আড়াই মাস থাকতে গেলে ভেতরে ভেতরে ঠোকাঠুকি হতেই পারে। সেই ঠোকাঠুকিগুলোই অনেক সময় সম্পর্ককে আরও মজবুত করে দেয়।” গাঁইগুঁই করতে থাকা আর এক মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানকে তিনি যে সবার সামনে সম্প্রতি ধমকেছিলেন। ইডেন ড্রেসিংরুমে বলেছিলেন, “বেশি মেজাজ দেখালে আমার ক্যাপ্টেন্সিতে দ্বিতীয় বার খেলবে না। বেছে নাও কী চাইছ।” প্রসঙ্গটা তাঁর সামনে নতুন করে তোলা হয় না। কেকেআর ক্রিকেটারদেরও নতুন করে বোঝার কিছু নেই। তারা জেনে গিয়েছে অধিনায়কের কোনও সিদ্ধান্ত আমার ভয়ঙ্কর অপছন্দ হতেই পারে। কিন্তু লোকটা যে নিরপেক্ষ সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
অজয় জাডেজার মতো অনেকেই মনে করেন গৌতম গম্ভীর হলেন মিনি গাঙ্গুলি। প্রকৃতিগত ভাবে অবিকল এক ধাঁচের। বার কয়েক ইন্টারভিউ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিকের মনে হবে
পর্যবেক্ষণ কিছুটা ঠিক, কিছুটা নয়। তিনি একই সঙ্গে আবার দ্রাবিড়। সম্ভবত বেশি দ্রাবিড়, কম গাঙ্গুলি। ভারতীয় দলে দ্রাবিড়ের প্রচলন করতে চাওয়া টিম থিম পাঁচ বছর আগে চরম প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কেকেআরে সেটাই মহা সমারোহে প্রতিষ্ঠা করেছেন গম্ভীর। যে থিম বলে, তারকার আগে দল। সব সময় দল। সৌরভ সম্পর্কে তিনি: এমন একজন লিডার যে ভারতীয় দলটাই তৈরি করেছিল। আজ ওর তুলে আনা লোকগুলোই সার্ভিস দিচ্ছে। দ্রাবিড় সম্পর্কে গম্ভীর: অনবদ্য। কোনও কথা হবে না। ক্রিকেটে যদি রোল মডেল বলে কাউকে জানি, সে দ্রাবিড়। সচিনের দিকে ড্রেসিংরুমে তাকাব বিপদে আপদে। বড় দাদা হিসেবে। কিন্তু দ্রাবিড়কে চিরকাল মেনে নেব আদর্শ হিসেবে। অ্যাডিলেডে জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচে যখন তৈরি হচ্ছিল, মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। কী সমর্পণ! প্রথম টেস্টে যা ছিল, শেষ টেস্টেও তা-ই।
আবার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কোথাও গিয়ে তিনি দ্রাবিড়+গাঙ্গুলি+অরিজিন্যাল গম্ভীর। একেবারেই ব্যতিক্রমী। নইলে আইপিএল ফাইনালে ওঠার পরের দিন সকালে বহির্জগতের উচ্ছ্বাসে স্নাত হতে হতেও কেউ ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা আঁকড়ে থাকে? আইপিএল ফাইনালে ওঠা ক্যাপ্টেন বলতেই পারেন এই ফর্ম্যাটটা এত নিষ্ঠুর যে, যে দিন বুঝব সামান্যতম লোক হাসাচ্ছি সে দিনই চলে যাব। সেটা আজ থেকে তিন মাস পরে হলেও চলে যাব। অনেকে এখনই বলতে শুরু করেছে, কেকেআরের ক্রিকেট দর্শন যে ভাবে তিনি বদলে দিয়েছেন তাতে অবসরোত্তর তাঁকেই করা উচিত ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট অপারেশন্স।
অথচ তিনি গৌতম গম্ভীর একেবারেই এ সব ছকে বাঁধা জীবনে বিশ্বাসী নন যে, এ-র পর অনিবার্য বি, বি-র পর অবধারিত সি। তাঁর জীবনের প্যাশন মোটেও ক্রিকেট নয়। বরং সামরিক বাহিনী। গৌতম গম্ভীরের কাহিনি স্বতন্ত্র এ জন্যই যে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় সন্তুষ্টি আইপিএল ট্রফি জেতা বা বিশ্বকাপ ফাইনালের ৯৭ নয়। তাঁর রোমাঞ্চ সীমান্তে গিয়ে দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করা। ছোটবেলা থেকেই এ রকম। আজও যদি তাঁকে বেছে নিতে বলা হয় ভারত অধিনায়কত্ব নেবে, নাকি ইন্ডিয়ান আর্মির মেজর জেনারেল হবে, তা হলে গম্ভীর এক সেকেন্ডও না নিয়ে পরের বিকল্পটা বাছবেন। “আইপিএল ফাইনাল বিরাট ব্যাপার নিশ্চয়ই। কিন্তু কাশ্মীরে গিয়ে যদি জওয়ানদের সঙ্গে দেশকে আক্রমণ করতে উদ্যত শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতাম, তার চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারত না।”
সামরিক বাহিনী যদি না হয়, তা হলে ক্রিকেট পরবর্তী জীবন কোন দিকে বওয়াবেন সেটাও ভেবে রেখেছেন। সমাজ বদলাতে চাইবেন। “সেঞ্চুরি দিয়ে বা কেকেআর-কে ফাইনালে তুলে মানুষের জীবন বদলানো যায় না। যাদের তিন বেলা খাওয়া জোটে না, তাদের জন্য বাইরে এসে লড়াই করতে হয়।” তা হলে কি রাজনীতিই পরের আস্কিং রেট? না, রাজনীতিও নয়। তাই রাইসিনা হিলে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে কার বসা উচিত সে সব আলোচনায় কোনও আগ্রহ নেই। তিনি সিস্টেমের বাইরে থেকে সিস্টেমকে প্রচণ্ড লড়াই দেওয়ায় বিশ্বাসী। যাতে সাধারণ মানুষের উপকার হয়। মাদার টেরিজা তাঁকে অসম্ভব টানেন। হালফিল অণ্ণা হজারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও প্রচণ্ড আকৃষ্ট।
২৭ মে ভারতের জাতীয় নির্বাচকদের সামনেই তাঁর জীবন বদলাতে পারে। কিন্তু গম্ভীরের কাছে নিজের জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন আগামী রবিবারও দিতে পারবে না। যেহেতু ক্রিকেট জীবনের ভরকেন্দ্রে নেই। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা কে, জিজ্ঞেস করে লজ্জা দিলাম না। মনে হল না শাহরুখ বলে। তা হলে কি আমির? নাকি আরও ব্যতিক্রমী নাসির?
নাকি তিনি নিজেই নিজের নায়ক? নিজেই নিজের ধ্রুবতারা? গুরু গম্ভীর। |