প্রবন্ধ ২...
বৈবাহিক সম্পত্তির ভাগ চাই সব মেয়ের জন্য
ম্প্রতি সংসদে হিন্দু বিবাহ আইনে (১৯৫৫) সংশোধনের যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তাতে বিচ্ছেদের সময় বৈবাহিক সম্পত্তির উপর স্ত্রীর দাবি স্বীকৃত হয়েছে। প্রশ্ন হল: কেন শুধু হিন্দু মেয়েদের জন্যই এই সংশোধন? কেন সব ধর্মের মেয়েদের জন্য নয়? যাঁরা সরকারের কাছে এই প্রস্তাব করেছিলেন, তাঁরা সব ধর্মের মেয়েদের জন্যই এই সুপারিশ করেছিলেন। জাতীয় মহিলা কমিশন, আইন কমিশনের ২০০৯-১০ সাল থেকে সুপারিশ, সুপ্রিম কোর্টের রায়, সব মিলিয়ে আলোচনাটা বিস্তৃত হচ্ছিল। এর পর ২০১১ সালে দ্বাদশ পরিকল্পনায় নারী বিষয়ক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, আন্দোলনের কর্মী, আইনজীবী প্রভৃতিদের নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা গোষ্ঠী তাদের সুপারিশে দ্ব্যর্থহীন ভাবে লেখে ‘কোনও দম্পতি বৈবাহিকজীবনে যা কিছু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি একত্র করেছে, তাকে বৈবাহিক সম্পত্তি আখ্যা দিয়ে বিচ্ছেদের সময় বা পরিত্যাগের সময় ভাগ করে নেবার জন্য একটি সুসংহত আইন প্রণয়ন করতে হবে’। এই উপদেষ্টা গোষ্ঠী সব ধর্ম বা গোষ্ঠীর দম্পতিদের জন্যই সেই সুপারিশগুলি রাখে। আরও বলে যে, এই ব্যবস্থা একত্রবাসী যুগলের ক্ষেত্রেও তা কার্যকর হবে।
বিবাহ সংক্রান্ত আইনে সংশোধন বা সংযোজন করার অধিকার রাজ্যেরও আছে। দীর্ঘদিন ধরে চালু স্থানীয় প্রথাকে রাজ্য স্বীকৃত দিতে পারে। গোয়ায় ১৮৬৭ সালে পর্তুগিজ শাসনের সময় যে দেওয়ানি বিধি তৈরি হয় এবং ১৯৩৯ সালে যা একটি বিধিবদ্ধ রূপ পায়, তার ৭ নম্বর ধারায় সব ধর্মের মেয়েদের জন্যই বৈবাহিক সম্পত্তিতে সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হয়, যেমন সেই অধিকার পাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক হয় বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বা পঞ্জিভুক্ত করা। ১৯৬১ সালে গোয়া স্বাধীন হওয়ার পরও কিন্তু তা রয়ে গেছে।
বর্তমান এই আইন সংশোধনীর ফলে সম্পত্তির অংশ দাবি করলেও বিচারকেরা স্থির করবেন কতটা অংশ বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রী পাবেন। যে কোনও পক্ষের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি এতে ধরা হবে না। আপত্তি তুলেছেন মেয়েদের আইনি সহায়তা দেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা। উপরোক্ত উপদেষ্টা গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য এবং প্রস্তাবিত সংশোধনের অন্যতম রূপকার আইনজীবী কীর্তি সিংহ বলেছেন, বিচারকরা এখনও সাধারণত যে মেয়ে বিবাহবিচ্ছেদ চান, তাঁদের প্রতি সদয় থাকেন না। তাই তাঁদের বিরূপতার ছায়া পড়বে সম্পত্তি বিভাজনের রায়ে। যেমন সম্প্রতি এক হাইকোর্টের বিচারক তাঁর রায়ে স্ত্রীদের ‘সীতা’ হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন, অর্থাৎ চোদ্দো বছর বনবাসের পর পুরস্কার পাতালে নির্বাসন। এখনও মেয়েরা বিয়ের পর প্রাণপাত করে সংসারকে সাজান, বাচ্চাদের বড় করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন, কিন্তু এই খাটুনির স্বীকৃতি পান না। হঠাৎ যদি বিয়ে ভাঙে, প্রতি পাঁচ জনে চার জন মেয়ে আবিষ্কার করেন যে তাঁর কোনও যাওয়ার জায়গা নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমনকী বাপের বাড়িও (মায়ের বাড়ি তো আমরা কখনও বলি না!) মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আরও সমস্যা হল যে, স্ত্রীরা বহু সময় স্বামীদের সম্পত্তির হদিশ জানেন না, এমনকী স্ত্রীর নামে কোনও সম্পত্তি থাকলেও তার কাগজ মেয়েদের হাতে কখনও থাকে না। তাই, মেয়েদের দুঃস্থতা থেকে বাঁচানোর জন্য করুণার ‘খোরপোষ’ শুধু নয়, তাঁরা চান বৈবাহিক জীবনের ত্যাগ আর শ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে সম্পত্তির সমান বাঁটোয়ারার অধিকার।
কেন্দ্রীয় সরকার না পারলেও এই মর্মে আইন প্রণয়ন করতে চেষ্টা করছে মহারাষ্ট্র সরকার। সেখানে প্রস্তাবিত বৈবাহিক সম্পত্তি (বিবাহে নারীর অধিকার) বিল ২০১২-তে বলা হয়েছে: বৈবাহিক সম্পত্তি বলতে স্বামীর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রী সমান অংশ পাবেন, এমনকী স্বামীর যৌথ ভাবে প্রাপ্ত জমি বা ব্যবসাতে, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটিতেও তাঁর সমান অধিকার থাকবে। স্বামী যদি কোনও সম্পত্তি বিক্রয় করতে চান, তা হলে বৈধ কেনাবেচার জন্য স্ত্রীর লিখিত সম্মতি লাগবে। কোনও সময় কোনও স্ত্রী যদি মনে করেন কোনও সম্পত্তি বিক্রি করে দিলে তাঁর বা তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যৎ পালন-পোষণের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে, তা হলে তিনি সেই বিক্রয়ে বাধা দিতে আদালতে যেতে পারবেন। দম্পতির মধ্যে কেউ বা সন্তানরা কেউ যদি শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত হন, তা হলে তিনি জীবনযাপনের জন্য যদি যুক্তি সহযোগে সম্পত্তির অর্ধেকের বেশি দাবি করেন, তা হলেও আদালত তা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবে। মজলিস সংগঠনের সহায়তায় মহারাষ্ট্রের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের বানানো এই খসড়ায় বিচ্ছেদ বা সেপারেশনের সময় বিবাহের সময়সীমা, দম্পতির বয়স, উভয়ের উপার্জনের ক্ষমতা, সম্পত্তির মূল্য, ধার ও দায়িত্ব, স্ত্রীর অর্থ ছাড়া অন্য অবদান এ সব বিবেচনা করে সম্পত্তি বিভাজনের সিদ্ধান্ত নেবে। আপত্তি তুলেছেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড-এর সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী আবদুল রহমান কুরেশি। তাঁদের মতে, এই বিল আইনে পরিণত হলে তা শরিয়তের বিরোধী হবে। এই খসড়া ও অন্যান্য আইনে প্রস্তাবিত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তাঁরা বিশেষ ভাবে সহায়তা চাইবেন তাঁদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন দুই মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অখিলেশ যাদবের কাছে।
বৈবাহিক সম্পত্তির বিভাজন সবার জন্য না শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য এই বিতর্কের মধ্যে উঠে আসছে আর একটি প্রশ্ন। বিয়েটা আদৌ হয়েছে না হয়নি, তার রেকর্ড না পেলে সম্পত্তির বিভাজনটা হবে কীসের ভিত্তিতে? সপ্তপদী হলেই হিন্দু বিয়ে হয়েছে ধরে নেওয়া হয়, কোনও খাতা থাকে না, যা কোনও বিতর্কের সময় রেকর্ড হিসেবে উপস্থিত করা যাবে। যদিও মুসলিম বিবাহ চুক্তি বলেই কাজী বা মসজিদের খাতা থাকে। খ্রিস্টানদের চার্চে বিয়ের খাতা থাকে, থাকে পার্সি বিয়েরও। কিন্তু সেই খাতা বা তার তথ্য সরকারের কাছে যাচ্ছে না বলে তা যে-কোনও সময়ে বদল করা সম্ভব, এবং তা হয়েও থাকে। অথচ ২০০৬ সালেই সুপ্রিম কোর্ট সারা ভারতে বিবাহ নথিভুক্ত করাকে বাধ্যতামূলক করতে বলেছে।
সারা ভারতে নানা রাজ্যে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক মুম্বইতে ১৯৫৩ সালের আইন মোতাবেক (মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে প্রযোজ্য), কর্নাটকে (১৯৭৬), হিমাচলে (১৯৯৬), অন্ধ্রপ্রদেশে (২০০২)। সুপ্রিম কোর্টের অ্যামিকাস কিউরেই সারা দেশ ঘুরে রিপোর্ট দেন, নানা রাজ্যে তা হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও সবার জন্য হয়নি। এর পর সকল সম্প্রদায়ের জন্য বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট আবার নির্দেশ দেয়। এটাও বলে যে, অসম, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা আর মেঘালয়ে মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রি করা ঐচ্ছিক, তাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সংসদের চলতি অধিবেশনে সলমন খুরশিদ জন্ম ও মৃত্যুর সঙ্গে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে বলে প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে নানা স্তরে নয়, রেজিস্ট্রেশন একবারই করতে হবে। আবার আপত্তি এসেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড থেকে। অবশ্য লখনউতে মিছিল করে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের সদস্যরা দাবি করেছেন যে সব নিকাকেও রেজিস্ট্রি করতে হবে।
আইনে থাকলেও মেয়েরা সম্পত্তির অধিকারী হন না। এ দেশে ধর্ম নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়ে নিজের কেরিয়ার নয়, ভাল করে সংসার করতে চান। যে দেশে মেয়েরা শেখেন বিয়েটাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য, সে দেশে সব সম্প্রদায়ের সব মেয়ের জন্যই বিয়ে ভাঙলে ন্যূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.