সে একটা তীব্র আবেগের ‘গ্রাম্য’ ভাষায় কথা বলে, কিন্তু কথা বলে। তাকে ভয়ে চুপ করে থাকতে হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে নতুন রাজনীতির উন্মেষ লক্ষ করছেন
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী |
এই রচনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই শব্দগুলি ব্যবহার করলে বেশ মানাত pre-social, transhistorical, নিদেনপক্ষে ‘death of the subject’ অথবা ‘dialectical relationship’। সারস্বতজীবনে দেখেছি, কুলীন স্থানগুলিতে যদি গোটা বক্তব্যের মধ্যে মাঝে-মাঝেই এই সব শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে কথা বলা যেত, তা হলে শ্রোতাকুলের মধ্যে বেশ একটা ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধা জেগে উঠত। তবে কিনা সেখানে অসীম দুরধিগম্যতার মধ্যে বক্তা মাঝে মাঝে বুদ্ধিদীপ্ত খণ্ড-রসিকতা করতেন, তাতে শ্রোতা যেন ধন্য হয়ে যেত। বস্তুত বক্তা-শ্রোতার মধ্যে এই যে দূরত্ব এই দূরত্বটা যে শ্রোতারা খুব পছন্দ করেন, তা নয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার মধ্যে গম্যতা না থাকার ফলে থমকানো ভয় একটা এমন থাকে, যেখানে বক্তব্য-শেষে শ্রোতা কোনও প্রশ্ন করে না। সে কিছুই না বুঝে বড় ভদ্র হয়ে থাকে।
রাজনীতিতেও এর একটা প্রকার আছে। কেননা, মুখে যতই গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র জাহির করুন, রবার্ট মিশেল-এর ‘আয়রন ল অব অলিগার্কি’ গণতন্ত্রেও যেমন মিথ্যে নয়, তথাকথিত গরিবজনের মান্য সমাজতন্ত্রেও সেটা মিথ্যে নয়। দেবতার মুখের চার পাশে যে ‘হেলো’ থাকে, সেটাকে মানুষ সমঝে চলে। অথবা, মনু যে-চক্রবর্তী রাজার সম্বন্ধে বলেছিলেন রাজা তো আদিত্য সূর্যের মতো সাধারণ মানুষের চোখও ধাঁধিয়ে দেন, মনও ধাঁধিয়ে দেন, দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে তাঁর দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি কথা বলতে পারে ন চৈনং ভুবি শক্নোতি কশ্চিদপি অভিবীক্ষিতুম্। |
গণতান্ত্রিক জীবনের অভিজ্ঞতায় অবশ্য এত কাল এটাই দেখেছি যে, গণরাজতন্ত্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কেউ কথা বলেনি; মুখ্যমন্ত্রী হাসলে সেটা খবরের কাগজে বেরোত। অবধারিত ভাবে তখন ‘ফুকোল্ডিয়ান পাওয়ার রিলেশনস’ থেকে আরম্ভ করে ‘কালচারাল হেজিমনি’ অথবা ‘কাউন্টার-পাওয়ার’ সব কথা আসতে পারে, কিন্তু সবার উপরে একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখচ্ছবি সেখানে বড় বেশি মুখ্য হয়ে পড়ত অন্য সমস্ত মানুষ, এমনকী অতিবড় মানুষও, সেখানে এক অস্বচ্ছন্দ দূরত্বে দাঁড়িয়ে শুধু অবস্থান-গর্বে মণ্ডিত বোধ করতেন। তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে কথা বললে সেই সব অর্ধবাক্য তিনি ‘সেনটেন্স’ প্রায়ই শেষ করতেন না কিন্তু সেই উচ্চারিত অর্ধবাক্যেই আমরা ধন্য হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডী মেনেছি অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচার্য্যা বিশেষতঃ। আর তিনি যদি আজ্ঞা করতেন কাউকে, তবে মনে হত যেন বরপ্রদান করেছেন এইমাত্র।
আমি কি আস্তে আস্তে counter-history কিংবা counter-memory ইত্যাদি কঠিন দার্শনিকতায় পৌঁছে গেছি, কেননা, তির্যগর্থে সাম্যবাদী আঁতলামি-র পরাজয় মানে সরলতা এবং গ্রাম্যতার জয়। আসলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বহুকাল ধরে যদি একটি দল শক্তির সুব্যবস্থায় অবস্থিত থাকে, তবে তার একটা সুসংহত ইতিহাস থাকে এবং তার চলমান ‘ইন্টারপ্রিটেশন’গুলি এমন ভাবেই চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকে, যাতে মানুষ ভাবতে থাকে এর বুঝি কোনও বিকল্প নেই, এটাই চরম সত্য। আমরা স্বাধীনতা-উত্তর কংগ্রেস পার্টি দেখেছি, সেখানে ‘পলিটিকাল এলিটস’ ‘যাঁরা’ ছিলেন অথবা ‘যিনি’ ছিলেন, তার ঘোর আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি, কিন্তু তাঁদের ইতিহাস, তাঁদের চাপিয়ে দেওয়া ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ ভেঙে গেছে। এক কথা জ্যোতি বসু, স্নেহাংশু আচার্য বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধেও।
পশ্চিমবঙ্গের বাম জমানার আদর্শগত ইতিহাস যা-ই থাকুক, যতই বলা হোক সেটা সাধারণ মানুষের মুক্তির ইতিহাস, আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় শুধু চুপ করে থাকতে হয়েছে বলেই সেই চাপিয়ে-দেওয়া ইতিহাসের ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ এত দিনে মিথ্যে হয়ে গেছে। ‘পাওয়ার স্ট্রাকচার’ এবং ‘পাওয়ার রিলেশনস’ এখানে শুধু সরকারের ঘরের জিনিস ছিল না, জনগণের একটা বিরাট অংশ শুধু বিনা-শ্রমে-পেয়ে-যাওয়া অর্থের প্রযুক্তিতে এতটাই সুসংহত উল্লম্বতা গড়ে তুলেছিলেন, যাতে চৌত্রিশ বছর ধরে শুধু মানুষ বাজারে গেছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, নীরবে মৈথুন করেছে, কিন্তু বাইরে কোনও কথা বলার সাহস করেনি। আমার মনে আছে অফিসটাইমে ট্রেনে দাঁড়িয়ে ঘামছি ঢাকুরিয়া স্টেশনে। মমতা তখন রেলমন্ত্রী। ঢাকুরিয়ার সিপিএম-পন্থীদের কিছু একটা সমস্যা হয়েছিল। কে বা কারা একটি তিন ফুটের দলীয় লাল পতাকা রেল ক্রসিংয়ের মাঝের জায়গায় রেল লাইনের মাঝখানে উদ্দণ্ড করে গেলেন। সেটা কে করল, কেউ দেখেনি। কিন্তু দেড়-দু’ঘণ্টা চলে গেল সেই তিন-ফুটি পতাকাটি কেউ সরিয়ে দেবার সাহস করল না। সবাই এক বার করে দেখে গলা বাড়িয়ে, আবার বকের গলা ভিতরে নিয়ে আসে এবং শুধু অপেক্ষা করে।
ট্রেনের লোকেরা সাধারণত খুব কথা বলেন এবং তাঁদের আমার খুব বিদ্বানও মনে হয়। কেননা, সচিনের টেনিস-এলবো কেন হল, তা থেকে শুরু করে পেঁয়াজের গোডাউন, ইতিহাসের বাবর থেকে অভিনেত্রীর নিতম্ব সর্বত্র তাঁদের এমন অবাধ গতি তাঁরা কিন্তু ট্রেনের মধ্যে এমন ঘর্ম-সময়েও সি পি এম সম্বন্ধে একটা কথাও বলতেন না। আমার বিশ্বাস, যে মাস্টারমশায়ের কার্টুন-কাণ্ড নিয়ে এত কাণ্ড হল, কতগুলি বোকা ছেলের দল বাড়িতে গিয়ে তথাকথিত হাতাহাতি করে এল শুধুমাত্র পলিটিকাল ট্রেনিং নেই বলে, সি পি এমের আমল হলে এ ঘটনা সুসম্পন্ন হত শৈল্পিক কুশলতায়। বেশি নয়, পাড়ার লোকাল কমিটি থেকে তিনটি লোক মাস্টারমশায়ের বাড়ি যেতেন, হাসিমুখে শুধু বলতেন ঘটনাটা ঠিক হয়নি, স্যর। এতেই যথেষ্ট হত।
আমরা যে counter-history কিংবা counter-memory-র বিচক্ষণ ভাবনা থেকে গ্রাম্য ভাষায় উত্তরণ করলাম, তার কারণ, এ রাজ্যের counter-history সেই সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা এমন এক নেত্রীর কাছ থেকে শক্তি পেয়েছিল, যে তারই ভাষায় কথা বলে, তারই মতো করে ভাবে, তারই মতো আবেগগ্রস্ত হয়ে বলে, society must be defended. আমার মনে আছে, সেই যে লোকগুলো ট্রেনলাইনে লাল পতাকার তিন-ফুটি ধ্বজদণ্ড দেখে অনুচ্চারে ঘর্মসিক্ত হচ্ছিল, তারা ২০০৯ সালের লোকসভা-পর্বের পর থেকে কথা বলতে আরম্ভ করল। যারা কথা বলতে পারছিল, তারা নিজেদের জয়ের কথা যত বলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেছে দীর্ঘকালীন পরাজয়ের কথা, কেন পরাজয় তার কথা। সেই পরাজয়ের কথা বলতে গেলে ভাষা সুনির্মিত ‘অর্ধমাত্রা’য় উচ্চারিত হয় না ভাষা সেখানে বড় স্পষ্ট, বড় তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
খুব বেশি করে গণতন্ত্রের কথা ওঠে এখন, ওঠে বাক্স্বাধীনতার কথা। শুধু জিজ্ঞাসা হয়, এই চৌত্রিশ বছরে ছায়ার পিছনে থাকা মানুষ কোন কথাটা বলতে পেরেছে। এখন তো এক-একটি পাড়ার লোকাল কমিটি থেকে আলিমুদ্দিন পর্যন্ত এক রা হচ্ছে না, যেখানে একই পংক্তিতে ভোজন করতেন সরকারও। এখন একটা বিড়ম্বনার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী যে বিবৃতি দিচ্ছেন, পুলিশ অফিসার তার উল্টো কথা বলতে পেরেছেন গণতন্ত্র তো এইখানেই। এখানে ছাত্রনেতা বাড়াবাড়ি করলে ঘোষিত ভাবে ভর্ৎসিত হন এটাই তো গণতন্ত্র। এখন এক জন পুলিশ অফিসার কর্তব্যচ্যুত হলে, তাঁর কেরিয়ারে হাত পড়ছে এটাই তো গণতন্ত্র। সাংবাদিকতার বিশ্বনাচে কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রেও যদি ধাক্কা লাগে, তবে আপনি মুখ্যমন্ত্রীকেও ‘প্রোভোক্’ করতে পারছেন, কেননা তিনি অর্ধমাত্রায় চিবিয়ে কথা বলেন না। এখনও তিনি সবার সঙ্গে শশা-মুড়ি খাচ্ছেন বলেই তাঁকে দিয়ে আপনি অনেক কথাই বলিয়ে নিতে পারছেন, যা হয়তো তিনি সেই ভাবে বলতে চাননি এবং যা হয়তো আপনার চরিতার্থতার কাজে লাগবে।
অনেকে বলছেন, মমতা এখনও বিরোধী নেতার মতোই কথা বলেন। আমরা বলব না, সত্যিই বদলায়নি এবং এইখানেই তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা থেকে আলাদা। ভোটের সময় মোহিনী কথা বলে তক্তে বসলেই সমস্ত দূরত্ব তৈরি করে ‘দেখছি কী করা যায়’ বলার অভ্যাস, কিংবা এমন আমূল বদলে যাবার অভ্যেস তো এই মহিলা রপ্ত করতে পারলেন না। ফলে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই আপনি যে চিরাচরিত দূরত্বে অভ্যস্ত, সেই অভ্যস্ত দূরত্বের আভিজাত্যহানি ঘটছে বলেই ‘যেমন ছিলেন তেমন আছেন’ লোকটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেকের অসুবিধে হচ্ছে। আপনাদের অসুবিধে হচ্ছে।
মহামতি ফুকো এক ধরনের subjugated knowledge-এর কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘knowledge from below... knowledges that have been disqualified as non-conceptual knowledges, as insufficiently elaborated knowledges: naive knowledges, hierarchically inferior knowledges, knowledges that are below the required level of erudition on scientificity.’ ফুকো সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে তোমার যা-ই মনে হোক, তুমি যেন ভেবো না যে, এই নিম্নালোকিত জ্ঞানটা একেবারেই সাধারণ জ্ঞান এবং তা অবজ্ঞেয় কোনও বস্তু। এমনও ভেবো না যে, তার মধ্যে কোনও ‘সায়েন্স’ নেই বা ‘এরিউডিশন’ নেই, বরঞ্চ তার খুব বড় প্রাসঙ্গিকতা আছে mainstream epistemic market-এ। বস্তুত এই নিম্নালোকিত প্রজ্ঞান যেহেতু সাধারণ একটা এলাকা থেকে প্রাদেশিক ভাবে উঠে আসে, তাই তা এতটাই ভিন্ন এবং ততটাই অসংবদ্ধ বলে সেটা derives its power solely from the fact that it is different from all the knowledges that surround it.
বস্তুত নীচ থেকে উঠে আসা এই প্রজ্ঞানের স্মৃতি থেকে গেছে উপর থেকে নেমে-আসা ঠান্ডা হাড়-হিম দমনের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মনুষ্যত্ব সর্বত্র এমন সর্বগত সেই দমন, যা প্রত্যেকটি ‘লোকালিটি’ থেকে প্রাদেশিক হয়ে উঠেছিল তারই ফল এই সাধারণ্য থেকে সর্বময় প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ মুখ্যমন্ত্রী হলেই বন্ধ হয়ে যায় না, পরিবর্তিত হয়ে যায় না আচার, আচরণ, ভাষা এবং আবেগ। যাঁরা মুখ টিপে উন্নাসিকতায় বলছেন আজকাল তো আবার বাইশে শ্রাবণ আর পঁচিশে বৈশাখ একাকার হচ্ছে তাঁরা যদি ভাল চাওয়া এবং ভাল করার আবেগটুকু বুঝতেন, তা হলে বুঝতেন বৈষ্ণববাড়িতে চুয়ান্ন বছর পরও যখন গুরুর নির্বাণ-তিথি পালিত হয়, তখন মৃত্যুদিন আর জন্মদিন একাকার উৎসবে পরিণত হয় তখন হরিদাসের নির্বাণ-তিথি চৈতন্যের ভাষায় হরিদাসের বিজয়োৎসবে আলোকিত হয়। কিন্তু আঁতেল মানুষেরা এই সর্বময়ী গ্রাম্য ভাষা ভয় পায়, কেননা যা কিছুই ঘটছে it is the reappearance of what people know at a local level, of these disqualified knowledges, that made the critique possible. |