সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার অপেক্ষাতেই যেন ছিল সরকার। বাজেট অধিবেশন মুলতুবির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আজ পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ৭ টাকা ৫০ পয়সা হারে বাড়ানো হল। পেট্রোলের দামের এক লাফে এতখানি বৃদ্ধি নজিরবিহীন। মনমোহন-সরকারের যুক্তি, ডলারের দাম ৫৬ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় অশোধিত তেল আমদানির খরচ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির আর্থিক স্বাস্থ্যও ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। এই অবস্থায় সরকারের সামনে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।
আজকের পরে ডিজেলের দামও বাড়ানো হবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে। পেট্রোলের দাম সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেওয়া হলেও ডিজেল, কেরোসিন ও রান্নার গ্যাসের দাম এখনও সরকারই নির্ধারণ করে। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী এস জয়পাল রেড্ডি এখন বিদেশে। গত কালই তিনি তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ডলারে অশোধিত তেলের দাম সামান্য বাড়লেও টাকার অবমূল্যায়নের ফলে সেই ধাক্কাটাই অনেক বেশি এসে লাগছে। সরকারি সূত্রের খবর, রেড্ডি দেশে ফেরার পরে শুক্রবারই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক বসবে। সেখানে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের তরফে ডিজেলে লিটার প্রতি ৫ টাকা হারে দাম বাড়ানোর দাবি তোলা হবে।
পাশাপাশি রান্নার গ্যাসে ভর্তুকিতে রাশ টানার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অর্থনীতিবিদ এম গোবিন্দ রাওয়ের বক্তব্য, শুধু টাকার অবমূল্যায়নের ফলে আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়া নয়, সামগ্রিক ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থা এত কোণঠাসা ছিল যে আর কোনও উপায় ছিল না। মনমোহন-সরকার যে রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানতে বা সংস্কারের পথে হাঁটতে ইচ্ছুক, বিনিয়োগকারীদের সেই বার্তা দেওয়াও জরুরি ছিল। সে দিক থেকেও পেট্রোলের দাম এতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পেট্রোলের দামবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বণিকসভা ফিকি-র তরফে বলা হয়েছে, এ বার কেরোসিন, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হোক। কারণ এগুলির পিছনে সরকারকে বিপুল ভর্তুকি দিতে হয়।
অর্থনীতির যুক্তি যা-ই বলুক, আজকের এই সিদ্ধান্তের পরে স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ আরও তীব্র করেছে বিরোধীরা। বলা হচ্ছে, সামনে যে হেতু কোনও বিধানসভা নির্বাচন নেই, তাই রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে এটাকেই উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। বাম-বিজেপির অভিযোগ, মূল্যবৃদ্ধির হার যখন এমনিতেই বেশি, তখন এই সিদ্ধান্ত আমজনতার বোঝা আরও বাড়াবে। ইউপিএ-সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন প্রধান শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এক লাফে এতখানি পেট্রোলের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ভুল আর্থিক নীতিকেই দায়ী করেছেন তিনি।
অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশও মনে করছেন, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্যই কেন্দ্রীয় সরকারকে এক লাফে এতখানি দাম বাড়াতে হল। ফলে সাধারণ মানুষের উপরে এক ধাক্কায় অনেক বেশি চাপ এসে পড়ল। পেট্রোলের দাম ঠিক করার দায়িত্ব তেল সংস্থাগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হলেও বাস্তবে তারা সরকারের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া কিছুই করতে পারে না। গত বছরের নভেম্বরে শেষ বার পেট্রোলের দাম বেড়েছিল। তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেন। মমতার চাপের কাছে মাথা নুইয়ে দু’দফায় পেট্রোলের দাম কিছুটা কমানোও হয়। এর পরে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম যথেষ্ট পরিমাণে বাড়লেও কখনও শরিকি চাপ, কখনও উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন, কখনও আবার সংসদের অচলাবস্থার কথা ভেবে পেট্রোলের দাম বাড়ানোর সাহস দেখাতে পারেনি মনমোহন-সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তেলের দাম বাড়লে-কমলে, ধাপে ধাপে অল্প অল্প করেই তেলের দাম বাড়ত। তাতে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে এক ধাক্কায় এতখানি বোঝা চাপত না। কিন্তু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে দীর্ঘদিন পেট্রোলের দাম না বাড়ায় এ বারে একবারে ৭ টাকা ৫০ পয়সা বাড়াতে হয়েছে।
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, গত বছর মে মাসেও ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছিল। সে বার পেট্রোলের দাম এক লাফে ৫ টাকা হারে বাড়ানো হয়েছিল। সে সময়ও পশ্চিমবঙ্গ-অসম-কেরল-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের কথা ভেবে জানুয়ারি মাসের পর থেকে আর তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ১৫ মে ভোটের ফল বেরনোর পরেই পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়। ডিজেলের ক্ষেত্রেও একই কারণে এক লাফে ৫ টাকা দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কারণ ডিজেলের দাম শেষ বার বেড়েছে গত বছরের জুন মাসে।
আজ ইন্ডিয়ান অয়েলের তরফে জানানো হয়েছে, ডিসেম্বর মাসে শেষ বার দাম বাড়ানোর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ১৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্য দিকে টাকার দাম পড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। প্রতি এক পয়সা টাকার পতনে তেল সংস্থার খরচ বাড়ে বছরে ৮ হাজার কোটি টাকা। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের বক্তব্য, অশোধিত তেলের দাম সোমবার ছিল ব্যারেল প্রতি ১০৬.৪৩ ডলার। গত কাল তা সামান্য বেড়ে ১০৬.৯৫ ডলারে পৌঁছয়। কিন্তু টাকার দামের অবমূল্যায়নের ফলে টাকার হিসেবে তা ৫৮১৯ টাকা ৫৯ পয়সা থেকে বেড়ে ৫৮৬৯ টাকা ৪২ পয়সায় পৌঁছেছে।
তেলের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের মধ্যেও দাবি উঠেছিল। প্রণববাবু নিজেও বারবার এর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। গত ১৬ মে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান সি রঙ্গরাজন চিঠি লিখে মনমোহন, প্রণব ও জয়পাল রেড্ডিকে জানান, তেল সংস্থাগুলির আর্থিক ক্ষতির কথা ভেবে দাম বাড়ানো জরুরি। তাঁর প্রস্তাব ছিল, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পেট্রোল ও ডিজেল, দুইয়েরই দাম লিটারে ৪ টাকা করে বাড়ানো হোক। এর ফলে তেল সংস্থাগুলির বছরে বাড়তি ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় হবে। এর পরে রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে ভর্তুকি চারটি সিলিন্ডারের মধ্যেই বেঁধে রাখার প্রস্তাবও দেন তিনি। তবে আজ সাড়ে সাত টাকা দাম বাড়ানোর পরেও তেল সংস্থাগুলি ফের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রেখেছে। ইন্ডিয়ান অয়েলের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থ বছরে এখনও পর্যন্ত যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে বাকি সময়ের জন্য আরও দেড় টাকা হারে দাম বৃদ্ধি প্রয়োজন। পাশাপাশি ডিজেল, কেরোসিন ও রান্নার গ্যাসেও যে তাদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি (আন্ডার-রিকভারি) হচ্ছে, তা-ও জানিয়ে রেখেছে ইন্ডিয়ান অয়েল। সংস্থার হিসেবে, চলতি অর্থবর্ষে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থার আন্ডার-রিকভারির পরিমাণ এক লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে। |