ঘরের মাঠে একটা দলের জন্য সাজানো মণ্ডপ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের বিসর্জন হয়ে গিয়ে একেবারে শোকযাপন চালু হয়ে যাওয়া। অষ্টমীর ভরা বাজার বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে দশমীর করুণ সুর বাজার মতো অবস্থা হলে যেমন হয়। আর একটা দল বিসর্জন ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে আচমকা অষ্টমীর আলো আর রোশনাইয়ের বরাত পেয়ে গেল। এর মধ্যে আবার আইপিএল ঘিরে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলও কি না বেঙ্গালুরু। পতনের শোক। উত্থানের উৎসব। বিতর্কের উত্তেজনা। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার্সের আগে নানা রকম রং মিলেমিশে একাকার বেঙ্গালুরুতে।
হিসেব মতো বুধবারের চেন্নাই সুপার কিংস বনাম মুম্বই ইন্ডিয়ান্স কোয়ালিফায়ার্স নয়। এর নাম হচ্ছে এলিমিনেটর। মানে এই ম্যাচ ঠিক করে দেবে কারা বাইরে চলে গেল। যারা জিতবে তারা চেন্নাইতে খেলবে পুণেতে হারা টিমের সঙ্গে। সেই ম্যাচে যারা জিতবে তারাই দ্বিতীয় ফাইনালিস্ট। এমনিতে চেন্নাই বনাম মুম্বই মানেই একটা বাড়তি আগ্রহের বলয় তৈরি হয়ে যাওয়া। ম্যাচের রিংটোনটাই যে প্রথমে সেট হয়ে যাচ্ছে। সচিন বনাম ধোনি। অস্ট্রেলিয়ার বিতর্কের পর তো আরওই আকর্ষক লড়াই হয়ে ওঠার কথা। সচিন সদ্য সদ্য আগের ম্যাচেই রান করে এসেছেন। মুম্বই দশ উইকেটে জিতেছে। বেঙ্গালুরুতে অসম্ভব জনপ্রিয় তিনি। এ দিনও নেট প্র্যাক্টিসে যাওয়ার অনেক আগে থেকে রেলিংয়ের এ পারে ঠায় দাঁড়িয়ে তাঁর ভক্তরা। বারবার বাইরে ছুটে যাচ্ছে দেখে আসতে যে, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বাস এল কি না। সচিনকে ব্যাট-প্যাড নিয়ে ড্রেসিংরুমের মধ্যে থেকে বেরোতে দেখে এমন গর্জন উঠল যে, নিরাপত্তারীক্ষরা তক্ষুনি ছুটে এসে ব্যারিকেড তৈরি করে দিলেন। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স এ বারের আইপিএলে দু’বারের মধ্যে দু’বারই চেন্নাইকে হারিয়েছে এই তথ্যটাও তো রয়েছে।
তবু কোথাও যেন একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। যার জন্য সরাসরি বলা যাচ্ছে না মুম্বই ইন্ডিয়ান্সই ফেভারিট। আর সেই খটকার কারণ মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নক-আউট রেকর্ড। তাঁরা এ বার যে ভাবে কোয়ালিফায়ার্সে গেছেন সেটাকে অনেকটা ফুটবলের বক্সের মধ্যে তালগোল পাকানো অবস্থায় কোনও রকমে কারও পা ছুঁয়ে বল জালে জড়িয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু একবার সেটা হয়ে যাওয়া মানেই তো কেল্লা ফতে। কোয়ালিফায়ার্সের খেলাটাই যে আবার নতুন খেলা! লিগে কী করেছ তার বিশেষ কোনও মূল্য নেই। একমাত্র তফাত হচ্ছে, এক বা দুই হতে পারনি বলে দু’টো সুযোগ পাবে না। প্রথমে হারলে সেখানেই শেষ। আর জিতলেও একটা ম্যাচ জিতলে হবে না। দু’টো জিতলে তবেই ফাইনালের ভিসা পাবে।
কিন্তু অধিনায়ক ধোনি যে নক-আউট পর্বের ম্যাচে অসাধারণ রেকর্ড অক্ষুন্ন রেখে এসেছেন এত কাল, সেটাকে অবজ্ঞা করার সাহস কে দেখাবে! আর এ দিন প্র্যাক্টিসে যে রকম চনমনে দেখাল তাঁকে এবং পুরো চেন্নাই টিমকে, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আচম্বিত শেষ চারে যাওয়ার বরাত পুরো টিমটার শরীরীভাষাই বদলে দিয়েছে। ধোনি এত কাল হ্যামস্ট্রিংয়ের যন্ত্রণায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলে যাচ্ছিলেন। এ দিন প্র্যাক্টিসে নামলেন দারুণ ফুর্তি নিয়ে। নেটে ঢুকে ছয় মারা প্র্যাক্টিস করলেন। হলুদ জার্সিতে তখন চেন্নাইকে দেখে মনে হচ্ছিল বেঙ্গালুরুর মাঠে যেন তাঁদের নবজাগরণই হয়ে গেল।
সন্ধে সাড়ে সাতটার পর প্র্যাক্টিসে আসা মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে সেই তুলনায় কিন্তু কিছুটা গুমরে থাকা মনে হল। হয়তো এটা কিছুই নয়। নিংড়ে নেওয়া সূচির ধকলের প্রতিফলন। বুধবারের ম্যাচ রাত আটটায়। তার আগে হরভজনদের চোখমুখও পাল্টে যাবে না, কে বলতে পারে! কিন্তু ম্যাচের আগেকার হাবভাব কোনও সূচক হলে দু’টো টিমের মধ্যে চেন্নাই অনেক বেশি চনমনে। মুম্বইয়ের গুমরে থাকার কোনও ক্রিকেটীয় কারণ থাকলে সেটা সম্ভবত ওপেনিং জুটি। কোয়ালিফায়ার্সে এসেও তারা ঠিক করতে পারছে না সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে কাকে ওপেনে পাঠাবে। ডোয়েন স্মিথ আগের দিন দারুণ খেলে দিয়েছেন। এ দিন শুনে বেশ আশ্চর্যই লাগল যে, স্মিথকেই বুধবার ওপেন করানো হবে কি না সেটা নিশ্চিত নয়।
বেঙ্গালুরু পৌঁছনো ইস্তক অবশ্য এমন হা-হুতাশ প্রত্যক্ষ করা গেল যে, মনেই হবে না এতকাল এটাকে রাহুল দ্রাবিড়ের শহর বলে লোকে চিনে এসেছে। অনিল কুম্বলের শহর বলে জেনে এসেছে। মনে হবে ক্রিস গেইলের শহর। ১৫ ম্যাচে ৭৩৩ রান। গড় ৬১। স্ট্রাইক রেট ১৬০। ছয় মেরেছেন মোট ৫৯টি। যা সব মিলিয়ে অনেক দল মেরে উঠতে পারেনি। ফাইনালে কে কার মুখোমুখি সেই নিষ্পত্তি হওয়া হয়তো বাকি থাকছে চেন্নাই পর্যন্ত। কিন্তু ধরেই নেওয়া হচ্ছে, আইপিএলের সর্বোচ্চ রানসংগ্রহকারী হিসেবে অরেঞ্জ ক্যাপের মীমাংসা করে দিয়েছেন গেইল। দ্বিতীয় স্থানে থাকা গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে গেইলের রানের তফাত ১০০ মতো। এত আগে থাকতে, টুর্নামেন্টের কোয়ালিফায়ার্স শুরু হওয়ার আগে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রহকারীর নাম ঠিক হয়ে যাচ্ছে, এমন উদাহরণ বোধহয় আর নেই।
সন্ধেয় যাঁরা ধোনির অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ছুটলেন, রাতে যাঁরা সচিনকে দেখে গর্জন করে উঠলেন, তাঁদের মুখেও তাই আক্ষেপ শোনা গেল, “এই ম্যাচটাতেই যদি আরসিবি থাকত! যদি ক্রিস গেইল খেলত!” কিন্তু সেটাই সব নয়। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু মানে তো আক্রান্ত দলও। আপান্নাকে নিয়ে যেমন আলোচনা চলছে তেমনই কৌতূহল সিদ্ধার্থ মাল্যকে নিয়ে। আর সেই কৌতূহলের এমনই জোয়ার যে, কেউ জানতে চাইছে না বুধবার রাহুল দ্রাবিড় খেলা দেখতে মাঠে আসবেন কি না? বরং অনেকেই জানতে চান, আইপিএল-কাণ্ডে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে পড়া সিদ্ধার্থ মাল্য কি মাঠে আসবেন? |