‘বাপজি, এ পথে আবার যে দিন আসবা, চলে আসতে লজ্জা পেয়ো না। গরিব আমরা,
তবু দুটো অন্ন ঠিক পাবা। এটা তোমারই বাড়ি।’ এক অনন্য পশ্চিমবঙ্গের
কাহিনি শুনিয়েছেন সুধীর চক্রবর্তী |
গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুরে সোনামুখী থেকে খয়েরবুনি গাঁয়ে যাচ্ছিলাম সনাতন দাস বাউলের আশ্রমে। রাঢ় বাংলার তীব্র গরমে আর তাপে প্রত্যেক বছর গ্রামদেশে নাকি এক জন, দু’জনের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তারা পথে বিপথে তখন বে-দিশা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। গাঁ-গঞ্জের মানুষ তাদের বলে ‘চোতখ্যাপা’। আমাকে দেখে একই মনে হবে অমন সুনসান জ্যৈষ্ঠের দুপুরে। যখন কুকুরও গেরস্থের বাইরের দাওয়ায় বসে জিভ বার করে ক্লান্ত, আমি চলেছি পথে। ব্রহ্মতালুতে ভিজে গামছা আর মাথায় ছাতা, সারা গায়ে রৌদ্রদাহ, চোখ দুটো রাঙা করমচা, একেবারে চোতখ্যাপার পাকা লক্ষণ। চার কিলোমিটার হেঁটে যখন সনাতন দাসের আখড়ায় ঢুকলাম, মানুষটা তার মাটির দাওয়ায় ঝিমানো অবস্থা থেকে তড়াক করে উঠে এসে বললেন, ভদ্রলোকের ছেলের এ কী দশা? এই ভাবে কেউ এতখানি রাস্তা হাঁটে? লোকে আমাদের মতো বাউলদের বলে, ‘খ্যাপা’, তা তুমি দেখি মস্ত খ্যাপা। বস দেখি ছিমায়। চোখ দুটো তো লালে লাল। এই বিশ্বনাথ ওঠ, বেলগাছে ওঠ। একটা পাকা বেল পেড়ে সেটা জলে গুলে পানা করে এঁকে এক্ষুনি এক গেলাস দে। সঙ্গে একটা চিনির মণ্ডা। খেলে গরমের তরাসটা কেটে যাবে। অবাক চোখে দেখলাম, সনাতনের ছেলে বিশ্বনাথ অক্ষরে অক্ষরে পিতৃআদেশ পালন করল। ঢকঢক করে সেই বড় এক কাঁসার গেলাসে বেলের সরবতের গ্রামীণ রেসিপি আমাকে ঠান্ডা করে দিল। বাউল বললেন, ‘এই বারে উঠোনের ওই টিউকলে মুখ হাত-পা ঠান্ডা জলে ভাল করে ধুয়ে মুছে আমার পাশটিতে আধ ঘণ্টা শুয়ে থাক। কোনও কথা নয়, চোখ বন্ধ কর।’ ছোটবেলার জ্যাঠামশাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। এই ভাবেই দুরন্ত
দুপুরে জোর করে পাশে শুইয়ে রাখতেন আর হাতপাখায় বাতাস করতেন। সঙ্গে যত আজগুবি ছেলেভোলানো গল্প।
এর পরে বেলা গড়িয়ে সূর্যের তেজ কমে গেলে বৃদ্ধ সনাতন দাসের নির্দেশে টিউকলের ঠান্ডা জলে স্নান করে খেতে হল এক কাঁসি গুড়-মুড়ি। তার পর সন্ধে নামলে বাউল নিজেই নিলেন একতারা, বেজে উঠল সাবলীল কণ্ঠবাদনে স্বায়ত্ত, স্বয়ংক্রিয় গানের পর গান। কোনও অর্থ প্রত্যাশা নেই। আছে আকুল স্নেহ আর অগাধ আতিথ্য। একান্ত আপন এক অহঙ্কার আমার মনের কোণে উঠল যে, উচ্চবর্ণের অভিজাত সমাজে আমি তো এমন পেতে পারি না, কিন্তু বাংলার গাঁ-ঘরের এ জাতীয় কুঁড়েঘরে আমার বরাবর এক চওড়া আসন পাতা আছে। গানের সুরের আসন, রাতে গায়কের সমৃদ্ধ সাধকজীবনের জ্ঞানদান ঘেরা অভ্যর্থনা। কে বলবে এর ভাঙা শরীরে ভরা আছে এত নিউট্রিশন। ঘুঙুরটা এক বার বাঁধলেই জমে যাবে রূপাঢ্য নৃত্যনাট্য। আর সেই সঙ্গে অন্তবর্তী গানের পরম্পরা। কথা বললে নিমেষে বোঝা যায়, বাউলত্ব ঘেরা রহস্য জগৎ তাঁর ঘোরা হয়ে গেছে। কাকে বলে ‘শব্দের ঘর’ আর কাকে বলে ‘নিঃশব্দের কুঁড়ে’ সে রহস্য বোঝেন। ‘বাউল প্রেমিক’ নামে সরল বাচনে যে চটি বই দুটি লিখেছেন, তা যেন তাঁর লেখা গানের ‘নলিন গুড়ের দানা’। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, ‘এত বড় মনের মানুষ, এত ভাবুক আর প্রেমিক, বাঙালির অহংকার করার মতো পরিসর এর গ্রহণীয়তায় কই তেমন তো উদ্বেল নয়! লোকায়তের পরিধি কি হেজিমনির প্রতাপে আত্মস্বর ব্যক্ত করতে পারবে না? দেশ-বিদেশের আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে বহু বার শোনা গিয়েছে সনাতন দাসের গান আর লুপ্তপ্রায় সেই বাউল ঘরানার নাচের বিভঙ্গ। সে সব আমাদের বঙ্গজীবনের অহংকৃত আর্কাইভাল সংরক্ষণ সম্পদ। কিন্তু তা নিয়ে হইচই তো কোথাও নেই। বাঙালির লোকায়ত জীবন নিয়ে বলবার শোনবার কথাকথন কতই যে আছে!
মনে পড়ে বীরভূমের কীর্নাহারের পথে যেতে শাসপুরে একটা মধ্যদিন কেটেছিল এক অনামা ফকিরের ভাঙা ঘরে। সে বিদেশেও যায়নি, গানের সমঝদারিও পায়নি। কপালে বাঁধা একটা কালো ফেট্টি, হাতে একটা অ্যালুমিনিয়মের তোবড়ানো সানকি। সেটাই বাদ্য। সে দিব্যি শুনিয়ে দিল একখানা মসজিদের গান। তার বউ নিজেই পেট ভরে খেতে পায় না, বাল-বাচ্চাদের অবস্থা হা-অন্ন। দিনান্তে ফকির যা কিছু পায়, ঝোলা ঝেড়ে ফেলে দেয় মেঝেয়। সেই পাঁচমিশেলি কদন্ন আর নানা কিসিমের সবজি সেদ্ধ করে সবাই মিলে হাম হাম করে খেতে খেতে ফকির বলেছিলেন, ‘আপনি হলেন মেহমান, মান্যমান মানুষ। এই খাদ্যই আজ আল্লাপাক বরাদ্দ করেছেন। এট্টু খান আমাদের সঙ্গে।’
ভাল ভাবেই খেলাম। নিজেকে রাজা-উজির মনে হল। যখন ফেরবার সময় ফকিরের বউ শান্ত গলায় বললেন, ‘বাপজি, এ পথে আবার যে দিন আসবা, চলে আসতে লজ্জা পেয়ো না। গরিব আমরা তবু দুটো অন্ন ঠিক পাবা। এটা তোমারই বাড়ি।’
এ আহ্বান তো আমি আজ পর্যন্ত এই ভব্যিযুক্ত ভদ্রলোকদের সমাজে কাউকে জানাতে পারিনি! |