সম্পাদক সমীপেষু...
বোনাস দিলেই শিক্ষকরা ভাল পড়াবেন?
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বাতী ভট্টাচার্যের লেখা ‘পাঠ্যক্রম নিয়ে অকারণ কচকচি বন্ধ হোক’ (১৯-৪) প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত একটি স্কুলের শিক্ষক হিসাবে কয়েকটি কথা জানাতে চাই। মাননীয় লেখকবৃন্দ বলেছেন যে, শিশুর যে-বই পড়তে ভাল লাগবে সেই বই যদি কমিক্সও হয়, শিক্ষকদের উচিত সেখান থেকেই প্রশ্ন করা। এ প্রসঙ্গে সবিনয় জানাই, পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন পছন্দের পরীক্ষা নেওয়া কি আদৌ বাস্তবে সম্ভব? এই লেখায় সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যে কারণে তাঁরা প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকেও বাতিল করার কথা বলেছেন। (যদিও তাঁর শিক্ষার ভাবনাকে তিনি হাতে-কলমে প্রয়োগ করেননি এ কথাটা কী করে বলা সম্ভব?) কিন্তু তাঁদের লেখাটিও সীমিত ও নির্বাচিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে লেখা। পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক চোখরাঙানি ইত্যাদি সত্ত্বেও শিক্ষকরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একটু ঘুরলেই সে তথ্যগুলি পাওয়া যায়। গলদ যতই থাক, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রজন্মে শিক্ষিতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকেও উঠে আসছে একটি শিক্ষিত সমাজ। শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের উপর যে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পরিকল্পনা চলছে, তার পিছনে যাঁরা আছেন, তাঁরা প্রতিকূল অবস্থায় কর্মরত এই শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কোনও প্রয়োজনই বোধ করেন না। যে কারণে বাণিজ্যিক জগতের পণ্য উৎপাদনের নিয়ম অনুযায়ী অনায়াসে তাঁরা বলতে পারেন শিক্ষকদের বোনাস দিলেই তাঁরা ভাল পড়াবেন। শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করলে সেটি আর যা-ই হোক, আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে না। অন্তত যে আনন্দের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। ‘আনন্দরূপম্ অমৃতং যদ্বিভাতি’।
মাননীয় লেখকদ্বয় রবীন্দ্রনাথ, মার্কস, বিবেকানন্দের শিক্ষাদর্শের ফলিত রূপ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। কারণ, সেগুলি নাকি যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ সংবলিত নয়। কিন্তু কোন তথ্যপ্রমাণে তাঁরা এই নিদান দেন যে, কমিক্স পড়াই ভাষাশিক্ষার আনন্দময় পথ? অভিজ্ঞতা বলে, শিক্ষাক্ষেত্রে ইনসেনটিভ-এর চেয়ে মোটিভেশনটাই প্রধান চালিকাশক্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায়তন শিক্ষার আনন্দক্ষেত্র ছিল, তখন সেখানে অর্থের তুষ্টি ছিল না। আজ ইনসেনটিভ-এর মহীরুহ সেটিকে কোথায় পর্যবসিত করেছে তা সবর্জনবিদিত। টাকাই একমাত্র প্রেরণা হলে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের পরেই দেশে শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ বিচ্ছুরিত হত। আবার অর্থ নিয়ে হিসাব শুরু হলে স্কুল ইন্সপেক্টরের নজরদারিটা জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু তখন বিদ্যালয়গুলি কনস্টেবল-রাজ্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। পাঠ্যক্রমের কচকচি বাদ দিয়ে কী ভাবে পড়ানো যেতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও লেখাটিতে তার পথনির্দেশ নেই। সেই পদ্ধতি ঠিক করায় শিক্ষকদের মতামত নেওয়া হবে কি না, জানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনিতে পারে, কিন্তু তাহার পণ্যতালিকার মধ্যে স্নেহ শ্রদ্ধা নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না’। বোনাসভুক্ত শিক্ষার কাছে তেমন প্রত্যাশা রাখা যায় কি?
পাঠ্যক্রম যে সময়োপযোগী হওয়া প্রয়োজন, সে আমরা সকলেই জানি। কিন্তু পাঠ্যক্রমের যে ভার, সেটা ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বহন করা সম্ভব কি না, তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের রসায়ন শিক্ষক হিসেবে বলতে চাই, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির রসায়নের যে বিপুল পাঠ্যবিষয়, তা এই অল্প সময়ে আয়ত্তে আনা কঠিন কাজ। এই সঙ্গে আছে প্রশ্নপত্রের নিত্যনতুন ধরন। যেখানে জ্ঞানমূলক প্রশ্নের সংখ্যা কমছে আর বাড়ছে বোধ ও প্রয়োগমূলক প্রশ্নের সংখ্যা। দরকার, বই খুব করে খুঁটিয়ে পড়া। কিন্তু তার সুযোগ কোথায়। স্কুলে তো আজ পড়াশোনাটা গৌণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্য ব্যাপার হচ্ছে আনুষঙ্গিক কাজ। যেমন ট্রেনিং, পরীক্ষা, নানা অনুষ্ঠান উদ্যাপন ইত্যাদি। শিক্ষক মহাশয়রা লেকচার মেথডে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আর প্রাইভেট টিউটর দ্রুত সাজেসটিভ নোট দিয়ে তাঁর দায়িত্ব সারেন। এর মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা সিলেবাসের বিপুল বোঝা নিয়ে যেন জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এগোয়। ফলে, বিজ্ঞান শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা, বিষয়ের প্রতি অনুরাগ, এ সব তো হচ্ছেই না। বরং ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটা একটা ভীতিজনক বিপুল তথ্যভাণ্ডার বহন করে নিয়ে যাওয়া বলে মনে হয়। সামনে আছে বিপুল প্রত্যাশা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক হওয়া। এর মধ্যে কিছু অতি গতিশীল ছাত্রছাত্রী তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই পিছিয়ে পড়ে। আর হতাশায় দিন কাটায়। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম যে একটা বড় কারণ, তা বলা যায়। এ বার ষষ্ঠ শ্রেণির গণিতের একটি ক্লাসের কথা বলি। একটি সেকশনে ৭০ জন ছাত্রের মধ্যে প্রায় ২০ জন ভাল পড়াশোনা করে। বাকিদের মধ্যে প্রায় ২৫ জনের উপস্থিতি খুবই অনিয়মিত। বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক সমস্যায় ভোগে। কেউ মাঠে বাবার সঙ্গে কাজ করে, কেউ ছাগল চরায়। অন্য ২৫ জনের অভিভাবক সচেতন হলেও তাদের উপযুক্ত মানে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। কারও গ্রহণ ও ধারণ ক্ষমতা খুবই কম। কারও আবার ওগুলো থাকলেও ভীষণ অস্থির। কেউ একেবারে চুপচাপ।
এই সব পিছিয়ে-পড়াদের খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে দরকার শিক্ষক মহাশয়দের অসীম ধৈর্য, সহনশীলতা ও এক নিরন্তর প্রয়াস। এটার অভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পাঠ্যক্রমের ভূমিকা একেবারে কম নয়। সম্প্রতি সর্বশিক্ষা দফতর থেকে সহায়ক পুস্তিকা ‘কাজের মাধ্যমে গণিত’ দেওয়া হয়েছে। এটি পিছিয়ে-পড়াদের খুবই উপযোগী, কিন্তু এগিয়ে থাকাদের কোনও কাজেই লাগে না। তাই ‘পিছিয়ে পড়া’দের নিয়ে যেমন পৃথক ক্লাসের ব্যবস্থা করা দরকার, তেমনই দরকার পৃথক পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়নবিধি।
বছর তিনেক ধরে সঞ্চয় করে রাখা কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা সবিনয়ে জানাতে চাই। বছর তিনেক আগে পূর্বালোকে এক বিকেলে আর্থিক ভাবে অনগ্রসর পরিবারের কিছু ছেলেমেয়ে যাদের বয়স ছয় থেকে বারো, তাদের গল্প বলা দিয়ে শুরু হয়েছিল একেবারে ঘরোয়া একটি আসরের। শিশুদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও চাহিদার ফলে গল্পের বই পড়া, বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করা, তার পর অধিকতর যোগ্য মানুষজনের উৎসাহে ও সাহচর্যে খেলাধুলা, নাটক, নাচ-গান আর সব কিছুকে ছাপিয়ে শিশুদের অন্তহীন আনন্দ ও উৎসাহে ঘরোয়া এই আসরটি আজও বড় জীবন্ত। এই শিশুগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশাই আমাদের উদ্বুদ্ধ করে স্থানীয় শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করতে। বিদ্যালয়ের বয়স এখন দেড় বছর। পঠন-পাঠন শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণি থেকে। এই মুহূর্তে বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা মাত্র ৫। গত দেড় বছর ধরে আমরা প্রতি দিন একটু একটু করে অনুভব করেছি যে, সিলেবাস ধরে কিছু শেখানোর চেষ্টা কতখানি অর্থহীন। নিশ্চয়ই সমাজের সর্ব স্তরের শিশুদের ক্ষেত্রে এই একই কথা খাটে না। কিন্তু এই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের কথাই বা সিলেবাস ভাববে না কেন? অপু-দুর্গার গল্প যাদের আপ্লুত করে, পাঁচুমামা কেমন লোক তা বুঝিয়ে বলতে যাদের কোনও অসুবিধা হয় না, ‘মারিয়ার বই’ যারা বারবার দেখতে চায়, হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনা যাদের স্তম্ভিত করে, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার গান শুনে যারা আনন্দ পায়, পরিবেশ ধ্বংস করাকে যারা আন্তরিক ভাবে ঘৃণা করে এবং অবশ্যই সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত বেশির ভাগ বিষয়ই যাদের ক্ষিপ্ত ও হতাশ করে তাদের কথা ভাবতে হবে বইকী। এই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াকুলের মধ্যে তারা আরও অভাগা, যাদের অভিভাবকরা অপেক্ষাকৃত বিত্তবান হওয়ার কারণে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে ঢোকে। আর সবার জন্য আছে ‘টিউশনি’। প্রাথমিক স্কুলের খরচ যাই হোক, দু’বেলা ‘মাস্টারের খরচে’ কিন্তু দিন আনি দিন খাই মানুষগুলি বেশ অভ্যস্ত। কী পড়ছে জানে না, কেন পড়ছে জানে না, সকাল নেই বিকেল নেই শুকনো মুখে, শূন্য চোখে পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে ঘুরে চলেছে। সব ইচ্ছে, ভাল লাগা জলাঞ্জলি দিয়ে দিনগত পাপক্ষয়। তার পর অসাধ্যসাধনের চেষ্টা ছেড়ে পড়াশোনার ইতি।
প্রকৃত শিক্ষা চিন্তা করার ক্ষমতাকে উসকে দিয়ে মনকে প্রসারিত করবে। যে যেখান থেকে আরম্ভ করছে, তাকে সেখান থেকেই তার মতো করে এগিয়ে দেবে। কে কী পারে না, তা নিয়ে তাকে নিরুৎসাহ না-করে, কী পারে তা আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন কি জরুরি নয়?
টিকিট মেশিন চালু হোক
শিয়ালদহে মেন, উত্তর ও দক্ষিণে বিশাল লাইন পড়ে প্রতিটি টিকিট কাউন্টারে। ফলে টিকিট পেতে পেতে অনেক ট্রেন মিস হয়ে যায়। একই ঘটনা আমাদের নব বারাকপুরেও ঘটে। তাই প্রাথমিক ভাবে অন্তত শিয়ালদহে মেট্রো রেলের মতো টিকেটিং মেশিন, কাউন্টার ও স্মার্ট কার্ড চালু করা হোক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.