প্রবন্ধ ১...যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
অরসিকের প্রতি রস নিবেদন,
ললাটে লিখো না, এই মিনতি


কটা গাছের ওপরের দিকে যদি কিছু ফল ফলে থাকে, তা হলে এক জন লম্বা মানুষ হাত বাড়ালেই সেই ফল ছিঁড়ে নিতে পারে। কিন্তু এক জন বেঁটে-বাঁটকুলও যদি সেই চেষ্টা করে, তা হলে তা দেখে লোকে হাসবে। সেই রকম, আমি এক জন মূঢ় মানুষ হয়েও যদি কবি হিসাবে খ্যাতি পাওয়ার জন্য লালায়িত হই, তা হলে লোকের কাছে হাস্যাস্পদ হব।
এটা বিনয়-বচনের এক চরম উদাহরণ। কারণ, এ কথা যিনি বলছেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কবি কালিদাস। ‘রঘুবংশ’ রচনার আগে তিনি এ কথা লিখেছিলেন। মূল সংস্কৃতে অবশ্য মূঢ় মানুষের বদলে রয়েছে ‘মন্দঃ কবিযশঃ প্রার্থী’। বাংলায় ‘মন্দ’ কথাটার অন্য অর্থ হয়ে যায়। এখন আর ‘রঘুবংশ’ ক’জনই বা পড়ে। তবু ‘মন্দ কবি যশ প্রার্থী’ এক কালে ব্যবহার করতেন বাংলার কিছু কিছু কবি। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও বাংলা গদ্য রচনায় মাঝে মাঝেই ব্যবহৃত হত সংস্কৃত শব্দ বা প্রবাদ। পাঠকদের তা বুঝতে অসুবিধা হত না। কারণ, তখনও স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। আমি নিজেও সংস্কৃত পড়েছি। ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে। অবশ্য খুব একটা ইচ্ছের জোর ছিল না, তার কারণ, এই ভাষা শিক্ষার পদ্ধতিটা ছিল নীরস আর কৃত্রিম। প্রথমেই শব্দরূপ আর ধাতুরূপ মুখস্থ করতে হত। (নরঃ, নরৌ, নরাঃ ইত্যাদি) তবু যেটুকু শিখেছিলাম তা আজও কাজে লাগে।
অনেক প্রবাদের পশ্চাতেই থাকে একটা করে গল্প। পুরোটা লেখার দরকার হত না, একটা ছোট শব্দেই বাকিটা বোঝা যেত। যেমন, কাউকে জোর করে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বোঝাতে শুধু লেখা হত, প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ। এর পিছনে গল্পটা কী? এক সময় চার লাইনের পুরো শ্লোকটিই আমার মুখস্থ ছিল। হঠাৎ কিছু দিন আগে একটা লাইন হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুতেই আর মনে পড়ে না। কোনও জানা জিনিস স্মৃতি থেকে পালিয়ে গেলে খুবই অস্বস্তি হয়। কোথায় খুঁজে পাব, তা জানি না। মানুষের স্মৃতি খুবই দুর্বোধ্য আচরণ করে। খুব প্রয়োজনীয় কোনও বিষয় স্মৃতি থেকে পিছলে চলে যায়। আবার কোনও এলেবেলে কথা মনে গেঁথে থাকে। যা যা হারিয়ে যায়, তার মধ্যে দু’একটি আবার ফিরেও আসে। যেমন, আজ সকালেই সেই হারিয়ে যাওয়া পঙ্ক্তিটি মগজে কেন যে ফিরে এল কে জানে?
ছবি: সুমন চৌধুরী
গল্পটা এই, এক বাড়িতে চারটি কন্যার স্বামীই ঘরজামাই। খায়দায়, আরাম করে, কিছুতেই যেতে চায় না। জোর করে তো তাড়িয়ে দেওয়া যায় না, জামাই বলে কথা। এদের মধ্যে যার নাম হরি, সে এক দিন খেতে বসে দেখল, তার পাতে ঘি দেওয়া হয়নি। তাতে অপমানিত বোধ করে সে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল (হবির্বিনা হরির্যাতি)। তার পর এক দিন মাধব নামে জামাই দেখল, খাওয়ার জন্য তার আসন পেতে দেওয়া হয়নি, তখন সে-ও সরে পড়ল (বিনা পীঠেন মাধবঃ) পরের জামাই পুণ্ডরীকাক্ষ দেখল, তার ভাতে কাঁকর (কদন্নৈঃ পুণ্ডরীকাক্ষঃ)। শেষ জামাইটি আর কিছুতেই যেতে চায় না। কোনও অপমানই সে গায়ে মাখে না। তার পর এক দিন তার শালারা তাকে মারধর শুরু করতে সে পালাতে বাধ্য হল (প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ)।
যস্মিন দেশে যদাচারঃ একটা বহুব্যবহৃত উৎপ্রেক্ষা। অর্থাৎ যে দেশে যা আচারবিচার তা মেনে চলতে হয়। এর পিছনে কোনও কাহিনি নেই। কিন্তু রয়েছে এক বিচিত্র তালিকা। যেমন, মগধ দেশে মদ্যপানে কোনও দোষ নেই। কলিঙ্গে অন্ন বিচার আর যৌন বিচার নেই। ওড্র দেশে (এখন এর নাম অন্য, কিন্তু সেটা আমি উল্লেখ করতে চাই না) ভ্রাতৃবধূ উপভোগে দোষ নেই। গৌড়ে মাছ খাওয়ায় দোষ নেই। আর দ্রাবিড় দেশে মামাতো বোনকে বিয়ে করা যায়।
অনেক প্রবাদই কবি কালিদাসের নামে চলে। সেগুলির ঐতিহাসিক সত্যতা কতখানি, তা বলা শক্ত। এক দিন কবি যাচ্ছেন রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় যোগ দিতে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাঁর স্ত্রী বললেন, বাড়িতে কিন্তু চাল বাড়ন্ত, ও বেলা আমরা কী খাব, তার ঠিক নেই। বাড়িতে চাল নেই, টাকাপয়সাও নেই কালিদাসের কাছে। তবু রাজার ডাকে যেতে তো হবেই। বৈঠক চলছে অনেকক্ষণ, রাজা বিক্রমাদিত্য লক্ষ করলেন, কালিদাস অন্য দিনের মতো হাস্যকৌতুকে যোগ দিচ্ছেন না। কবিতার লাইনও বলছেন না। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমার কী হয়েছে কবি?
কবি বললেন, দারিদ্র হচ্ছে ছাই দিয়ে ঢাকা আগুনের মতো। তাতে গুণের স্ফুরণ হয় না। অন্নচিন্তায় কাতর হলে কবিতা আসবে কী করে? ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা কাতরে কবিতা কুতঃ’। পৃথিবীর নানা ভাষার অনেক কবিই কখনও না কখনও এ রকম কথা উচ্চারণ করেছেন। ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’, চমৎকারা শব্দটির ব্যবহার অত্যাশ্চর্যজনক।
‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ এই ব্যাপারটা বোঝবার জন্য কোনও বাংলা শব্দ নেই। দেবী পার্বতী যখন মহাদেবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার কল্পনায় গভীর তপস্যায় নিমগ্ন, তখন স্বয়ং শিব ছদ্মবেশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। এবং খুব শিব-নিন্দা করতে লাগলেন। পার্বতী তখন কানে হাত চাপা দিয়ে সে স্থান থেকে সরে যেতে চাইলেন। মহাদেবও ছদ্মবেশ খুলে দাঁড়ালেন তাঁর পথ রোধ করে। তখন পার্বতীর কী অবস্থা, তিনি যাওয়ার জন্য যে পা তুলেছিলেন, দাঁড়িয়ে রইলেন সেই ভাবে। এই সময়ের বর্ণনা দিতে কালিদাস লিখেছেন, নদী যখন কোনও পাহাড়ের কাছে গিয়ে আটকে যায়, তখন সে এগোতেও পারে না, আবার স্থির হয়েও থাকতে পারে না। পার্বতীর অবস্থা সে রকম, ন যযৌ ন তস্থৌ!
একটি প্রবাদ আমার ছেলেবেলা থেকেই প্রিয়। কোন অজ্ঞাত কবি এ রকম একটি মোক্ষম উক্তি করেছিলেন, তা জানি না। ‘শিরসি মা লিখ’ পড়লেই সেটা মনে পড়ে যায়। কবি বিধাতাকে অনুরোধ জানিয়ে বলছেন, তুমি আমাকে যত রকম দুঃখ দিতে চাও, দাও। কিন্তু কোনও বেরসিকের কাছে রসের নিবেদন করার যে দুঃখ, তা আমার কপালে লিখো না, লিখো না।
‘অরসিকেষু রসস্য নিবেদনং শিরসি মা লিখ, মা লিখ।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.