ডাক্তারি ছাত্রদের গ্রামে কাজ করিবার সময়সীমা বাড়াইবার প্রস্তাব বিবেচনা করিতেছে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। যাঁহারা প্রস্তাবের সমর্থক, তাঁহারা গ্রামীণ চিকিৎসার উন্নতি এবং নবীন চিকিৎসকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণের সম্ভাবনা দেখিতেছেন। বিপক্ষ বলিতেছে, অল্প-শিক্ষিত, অতি-অনিচ্ছুক চিকিৎসকদের গ্রামে পাঠাইয়া কী লাভ? পরিকাঠামোর অভাবে ডাক্তাররা দক্ষতা বাড়াইতেও পারিবেন না। ইহা গ্রামের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার একটি ভনিতা মাত্র। দুই পক্ষেই সারবত্তা রহিয়াছে। কিন্তু দেশের চিকিৎসা নীতি নির্ধারণ করিতে হইলে ডাক্তারি ছাত্রদের অধিক সময়ের জন্য গ্রামে পাঠাইবার সিদ্ধান্তটি সমর্থন করিতে হয়। প্রথমত একটি ভ্রান্তির অবসান হওয়া প্রয়োজন। যে কোনও পেশার মানুষের নিকট গ্রামে কাজ করা শাস্তি নহে, তাহা একটি সুযোগ, এই বোধটিকে দৃঢ় করিতে হইবে। বিভিন্ন সরকারি কর্মীদের প্রশিক্ষণের মূল অংশ গ্রামে পরিষেবা প্রদান, কারণ গ্রামে বাধা-বিপত্তি অধিক, সুযোগ-সুবিধা কম। সেই অভিজ্ঞতা একজন সফল পেশাদার গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করে। চিকিৎসকরাও ব্যতিক্রম নহেন সীমিত প্রযুক্তি, সামান্য উপকরণেও যদি বিচিত্র রোগের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, তাহা চিকিৎসার কুশলতা বাড়াইবে, সন্দেহ নাই।
নীতির প্রশ্নটিও রহিয়াছে। ভারতের অধিকাংশ মানুষ গ্রামেরই বাসিন্দা, দেশের উন্নয়নের অর্থ গ্রামের উন্নয়ন, ইহা কার্যে সাধন করিবার বেলায় বিস্মৃত হইয়া পড়েন। বিশেষত চিকিৎসকরা বিপুল পরিমাণ সরকারি ভর্তুকি পাইয়া সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পড়াশোনা করিয়া থাকেন। তাঁহারা চিকিৎসাকে কেবল সমৃদ্ধি-প্রতিপত্তির হাতিয়ার বলিয়া দেখিলে তাহা একান্ত অন্যায় হয়। দেশের মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন সাধিত করিবার জন্যই প্রতি চিকিৎসকের জন্য বহু ব্যয় করা হইয়া থাকে, চিকিৎসকের দক্ষতা জাতীয় সম্পদ, ব্যক্তিগত পুঁজি নহে। তাহা জনস্বার্থে ব্যবহার করিবার দায় থেকে কোনও যুক্তিতেই চিকিৎসক অব্যাহতি পাইতে পারেন না। ইহা তাঁহার নাগরিক দায়, যাহার বিকল্প নাই।
পরিকাঠামোর অভাবে চিকিৎসকের গ্রামবাস বৃথা হইবার যে আশঙ্কা শোনা যাইতেছে, তাহা অজুহাত মাত্র। দশ বৎসর পূর্বেও এ রাজ্যে ডাক্তারদের সংগঠনগুলি হাসপাতালে পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ করিয়াছিলেন, এখনও বাঁধা গত গাহিতেছেন। ইতিমধ্যে কয়েকশো কোটি টাকা বিশ্ব ব্যাঙ্কের ঋণ, এবং আরও বিপুল পরিমাণ টাকা নানা প্রকল্পের অধীনে দেশের সরকার খরচ করিয়াছে, যাহাতে ব্লক ও জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিতে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যায়, রাজধানীতে ভিড় করিতে না হয়। যদি সে সকল টাকাই জলে গিয়া থাকে, তবে ডাক্তাররাও তাহার দায় এড়াইতে পারেন না। কারণ স্বাস্থ্য দফতরের প্রশাসনিক নানা পদেও রহিয়াছেন বহু চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালগুলির নানা স্তরেও দায়িত্বে রহিয়াছেন তাঁহারাই। তাঁহারা টাকা কাজে লাগাইতে পারেন নাই কেন? কেন রোগীর স্বার্থে, এবং চিকিৎসায় উৎকর্ষের স্বার্থে, উন্নততর পরিকাঠামো গড়িবার জন্য সরকারের উপর চাপ দেন নাই? সমাজে চিকিৎসক গোষ্ঠী নিতান্ত অসহায়, বলহীন, এমন কথা কেহ বিশ্বাস করিবে না। নিজেদের নানা দাবিতে চিকিৎসকরা সরব, রাজনীতিতে ও সমাজে তাঁহাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অবিসংবাদিত, পেশার ক্ষেত্রে নানা ধরনের কদাচার করিলেও তাঁহাদের বিচার ও শাস্তি প্রদান প্রায় অসম্ভব। তৎসত্ত্বেও যদি তাঁহাদের কর্মস্থল অনুন্নত রহিয়া গিয়া থাকে, তবে নবীন চিকিৎসকদের অসুবিধার দায় জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদেরই স্বীকার করিতে হইবে। গ্রামবাসীর অসুবিধা করিবার অধিকার তাঁহাদের নাই। |