হত্যায় অভিযুক্ত এক পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দেয়নি আগের বাম সরকার। নিহত যেহেতু তৃণমূলের কর্মী, রাজ্যে পরিবর্তনের পরে অন্তত অনুমতি মিলবে বলেই আশা করেছিলেন নিহতের পরিজন। কিন্তু মেলেনি। হতাশ পরিবারটির কাছে আলোর-বিন্দু হয়ে এসেছে গত ২ মে হাইকোর্টের একটি নির্দেশ। একই ঘটনায় অভিযুক্ত অন্য দুই পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে আগেই জারি হওয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করায় কোনও বাধা নেই বলে জানিয়েছেন বিচারপতি কাঞ্চন চক্রবর্তী। ওই নির্দেশেই ফের বিচার পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছে নিহতের পরিবার।
২০০১-এর ১০ মে, বিধানসভা নির্বাচনের দিন বেলেঘাটার সুরা ইস্ট রোডের বাসিন্দা, তৃণমূল কর্মী বছর বিয়াল্লিশের রবীন্দ্রনাথ ওরফে তোপি দাসকে টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ সুভাষ সরোবরের জলের মধ্যে পিটিয়ে মারে বলে অভিযোগ। দলীয় কর্মীর মৃত্যু ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূল নেতৃত্ব বাম সরকারের ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে সরব হন। সরকার অবশ্য আমলই দেয়নি অভিযোগে। আলিপুরের সিজেএম আদালতে অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের শাস্তি চেয়ে আবেদন করেন তোপির স্ত্রী সাধনাদেবী। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তিন পুলিশকর্মীকলকাতা পুলিশের তদানীন্তন এক অ্যসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এসি) শঙ্করণ মৈত্র, ফুলবাগান থানার সে সময়ের ওসি সমরেন্দ্রনাথ কুণ্ডু এবং হেড কনস্টেবল সুধাংশু সিকদারের বিরুদ্ধে খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপাট এবং অপরাধে মদতের ধারায় মামলা গ্রহণ করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন বিচারক। |
হাইকোর্ট তিন পুলিশকর্মীর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টেও খারিজ হয় শঙ্করণবাবুর আর্জি। তার পরেও বাম-সরকার গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করেনি। সরকারি কাজের সময়ে কোনও ঘটনার সূত্রে মামলা চালাতে হলে সরকারি অনুমোদন প্রয়োজনএই যুক্তিতে অভিযুক্ত পুলিশকর্মীরা ফের হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, কাউকে লাঠি পেটা করে হত্যা সরকারি কাজের মধ্যে পড়ে না। অনুমোদন লাগবে না। হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে এসি শঙ্করণ মৈত্র ফের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। সুপ্রিম কোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পদমর্যাদার অফিসারের বিরুদ্ধে মামলায় সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানায়। সেটা সেই ২০০৬। তার পরের ৬ বছরেও, যার মধ্যে রয়েছে তৃণমূল আমলের এক বছর, সরকারি অনুমোদন আসেনি।
সমরেন্দ্রনাথ কুণ্ডু, সুধাংশু সিকদারদের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও অনুমোদনের প্রশ্নও ছিল না। কিন্তু শঙ্করণ মৈত্রের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের জেরে অন্য দু’জনের বিরুদ্ধে পরোয়োনা কার্যকর করা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। সেই জটিলতারই অবসান হয়েছে হাইকোর্টের গত ২ মে-র নির্দেশে। ইতিমধ্যেই অবশ্য অভিযুক্তরা প্রত্যেকেই অবসর নিয়েছেন। এসি শঙ্করণ মৈত্রের ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকার এক বছরেও প্রয়োজনীয় অনুমতি না দেওয়ায় হতাশ তোপিবাবুর স্ত্রী সাধনাদেবী। তাঁর কথায়, “বাইপাসে তৃণমূল ভবনের বাইরে শহিদ-তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে আমার স্বামীর নাম। অথচ, তৃণমূলের সরকার এক বছরেও অনুমতির বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্যই করল না। কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রীকেও চিঠি দিয়েছিলাম। কিছুই হল না।” সরকারি তরফে কোনও ক্ষতিপূরণও পায়নি পরিবারটি। তবু আইনজীবী শেখর বসু, শুভাশিস রায়দের সহযোগিতায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সাধনাদেবী। বিচারের আশা নিয়েই রয়েছেন অপেক্ষায়।
আইন ও বিচারমন্ত্রী মলয় ঘটকের অবশ্য আশ্বাস, “অনুমোদনের বিষয়টি আটকে থাকার ব্যাপারে আমার জানা ছিল না। কী করা যায়, নিশ্চয়ই দেখব।” বেলেঘাটার তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পালের সঙ্গে যোগাযোগ করে
হলে ‘তোপি দাসকে চিনতেন’ জানিয়ে বলেন, “মামলার অনুমতি কেন এখনও মেলেনি, সে নিয়ে সরকারিস্তরে খোঁজ নেব। সরকারি সাহায্যের ব্যাপারেও কী করা যায়, দেখছি।” কিন্তু রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে কেন সেই খোঁজটুকু নিলেন না দলীয় নেতৃত্ব, সেটাই প্রশ্ন সাধনাদেবীর। |