ঐতিহ্যকে কুর্নিশ করার মেজাজটা অটুট থাকল। সংস্কৃতির প্রবীণ স্থপতিদের আলোকবৃত্তে ঠাঁই পেলেন সবে শিল্পী জীবনের মধ্যগগনে পৌঁছনো গুণিরাও।
রাজ্যের কৃতী সন্তানদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘বঙ্গবিভূষণ’-এর পরম্পরা গত বছরই শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার খানিকটা তরুণতরদের কথা মাথায় রেখে ‘বঙ্গভূষণ’-পুরস্কারের ধারাও সূচিত হল। পরিবর্তনের বর্ষপূর্তিতে সরকারি উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে এখন উৎসবের আবহ। রবিবারের সন্ধ্যায় গুণিজন-সম্বর্ধনার অনুষ্ঠানও সেই উদ্যাপনের অঙ্গ।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মঞ্চের চাঁদের হাটে মুখ্যমন্ত্রী এক মুহূর্তের জন্য ফিরে গেলেন ঠিক এক বছর আগের দিনটিতে। ২০ মে, ২০১১ সালের ওই দিনেই ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে শপথ নেয় মমতার মন্ত্রিসভা। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “বাড়ি থেকে বেরনোর আগে মা-বাবা বা গুরুজনদের প্রণাম করার মতো এই অনুষ্ঠানও আসলে গুণিজনের আশীর্বাদ নেওয়া।
তাঁদের শুভেচ্ছা পাথেয় করে আর একটি বছরের কাজ যাতে নতুন করে শুরু করতে পারি।” রাজ্যের তৃণমূল সরকারের শপথ গ্রহণের দিনটিই এ বার থেকে ‘বঙ্গবিভূষণ’-প্রদানের তারিখ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিলেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী বা জননেত্রীর দৃপ্ত শরীরী ভাষা দূরে সরিয়ে গুণিদের মাঝে এই সন্ধ্যার মমতা যেন বিনীত গৃহকর্ত্রী। মঞ্চে আসীন ‘বাংলার পথপ্রদর্শক’দের সবার কথা আলাদা করে বলার ফাঁকে বারবার বললেন, “আপনাদের আর কী-ই বা দিতে পারি! এটুকুই আমাদের সব থেকে বড় সম্মান।”
কৃতীদের কথা তুলে ধরে জায়ান্ট স্ক্রিনে পরপর ‘অডিও-ভিস্যুয়াল’ উপস্থাপনা। ‘বঙ্গবিভূষণ’দের মধ্যে হকির কিংবদন্তী অধিনায়ক লেসলি ক্লডিয়াস, নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তরুণতরদের কীর্তি উঠে এসেছে সশ্রদ্ধ ভাবে। “সৃজনের কাজে পুরস্কার-তিরস্কার দু’টোই জোটে। |
সুচিত্রা সেনকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান দিল রাজ্য সরকার। তাঁর তরফে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে
সেই সম্মান গ্রহণ করলেন সুচিত্রার মেয়ে মুনমুন এবং নাতনি রাইমা। রবিবার। ছবি: রাজীব বসু। |
আমি এই সম্মানে তৃপ্ত” বলেছেন ছোট-বড় সবার প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কবিদের মধ্যে এই স্বীকৃতি জয় গোস্বামীর। চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রথম ‘বঙ্গবিভূষণ’-প্রাপক যোগেন চৌধুরী সব শিল্পীদের তরফে এই সম্মান গ্রহণ করেছেন। ‘চাকভাঙা মধু’ বা ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র স্রষ্টা বিভাস চক্রবর্তীর মতে, “এ হল সামগ্রিক ভাবে বাংলা থিয়েটারের স্বীকৃতি।” ‘নাথবতী অনাথবৎ’-‘কথা অমৃত সমান’-এর নাট্যভাষার রূপকার শাঁওলি মিত্র রাজ্য সরকারের কাছে নাটকের জন্য আরও পরিকাঠামোর আর্জি জানিয়েছেন। সানাই-শিল্পী উস্তাদ আলি আহমেদ হুসেন অভিভূত হয়ে কথার খেই হারিয়ে ফেলেছেন।
চলচ্চিত্র-জগতের রঞ্জিত মল্লিক-গৌতম ঘোষেরাও
এ বার বঙ্গবিভূষণ। তবে প্রত্যাশা মতোই অন্তরালবর্তী কিংবদন্তী সুচিত্রা সেনের দেখা মেলেনি। বাঙালির চিরকালের ‘রিনা ব্রাউনে’র হয়ে সম্মান নিতে হাজির তাঁর মেয়ে মুনমুন সেন ও নাতনি রাইমার গায়ে এক সঙ্গে উত্তরীয় জড়িয়ে দিয়েছেন মমতা। বিদেশে অনুষ্ঠান থাকায় আসতে পারেননি হিন্দুস্থানি সঙ্গীত ঘরানা থেকে শুরু করে বাংলা গানের বিশিষ্ট পথিক অজয় চক্রবর্তীও। তাঁর স্ত্রী চন্দনাদেবী স্বামীর হয়ে স্মারক নিয়ে গেলেন। তরুণতরদের মধ্যে ‘বঙ্গভূষণ’ ধ্রুপদী সঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী রশিদ খান, তবলাশিল্পী বিক্রম ঘোষ ও আধুনিক গানের নচিকেতা চক্রবর্তী। এই স্বীকৃতিতে তিন জনই আপ্লুত। বিক্রম বললেন, “বরাবর এ রাজ্যে থেকেই এই সরকারি স্বীকৃতি পেলাম বলে বেশি ভাল লাগছে।”
‘ভারতরত্ন’ পণ্ডিত রবিশঙ্করকেও এ বার ‘বঙ্গবিভূষণ’ দিতে চেয়েছিল রাজ্য সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বলেই সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে। ১৩ জন বঙ্গবিভূষণ-এর জন্য দু’লক্ষ টাকার সঙ্গে তিন জন বঙ্গভূষণদের হাতেও এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে রাজ্য সরকার। সঙ্গে তাম্রপত্র, মিষ্টি, প্রীতি-স্মারকের অর্ঘ্য। গত বছরের বঙ্গবিভূষণদের মধ্যে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ও হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও মঞ্চে ডেকে নেন মমতা। প্রয়াত বঙ্গবিভূষণ শৈলেন মান্নাকেও স্মরণ করা হয়। আবেগের সংক্রমণ তখন প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। |