অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে তাঁর মা অমিতাদেবীকে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছিলেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা রঞ্জিত গুপ্ত। রঞ্জিতবাবুর পারিবারিক-সূত্রের খবর, সেই অভিনন্দনবার্তার জবাবে অমিতাদেবী শান্তিনিকেতন থেকে লিখেছিলেন, দুঃসময়ে আপনার (রঞ্জিতবাবুর) সাহায্য না-পেলে ওর (অমর্ত্যবাবু) জীবনের অভিমুখ হয়তো ভিন্ন খাতে বইত।
কেন এ কথা লিখেছিলেন
অমর্ত্য-জননী?
ব্যাপারটা বুঝতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে চল্লিশ বছরেরও বেশি। ১৯৬৯ সালে। অমর্ত্য সেন তখন দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ পড়াচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল বাম মনোভাবাপন্ন কিছু ব্যক্তির। “যাঁদের অন্যতম ছিলেন প্রভাত পট্টনায়ক।” বলছেন রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি অমিয় সামন্ত। ওই সময়ে অমর্ত্যবাবুর গতিবিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ হয়েছিল। তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছে অমর্ত্য সেন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চান। এমনকী, তখন অমর্ত্যবাবুকে গ্রেফতার করারও পরিকল্পনা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সে সময়কার কিছু পুলিশ অফিসার।
তবে রাজ্য পুলিশের তদানীন্তন ডিআইজি (আইবি) রঞ্জিতবাবুরই হস্তক্ষেপে সে ‘পরিকল্পনা’ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। রঞ্জিতবাবুর ছোট ছেলে অম্বর গুপ্ত রবিবার বলেন, “বাবার সঙ্গে অমর্ত্যবাবুর পরিবারের ভাল পরিচয় ছিল।” তার সুবাদে রঞ্জিতবাবু অমর্ত্যবাবুর বাবাকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছিলেন। রঞ্জিতবাবুর বড় ছেলে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের কথায়, “বাবা অমর্ত্যবাবুর বাবাকে ডেকে পাঠান। পরামর্শ দেন ছেলেকে অবিলম্বে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার।”
পুলিশকর্তা হিসেবে নকশাল দমনে যেমন দক্ষতা দেখিয়েছেন, তেমন অমর্ত্য সেনের ‘গ্রেফতারি’ আটকানোর মতো কাজও করেছেন। ‘অতি বাম’ হিংসায় লাগাম পরানোর পাশাপাশি ‘বাম-ঘনিষ্ঠতা’র তকমাও লেগেছে তাঁর ‘কেরিয়ারে।’ আর এমন বিবিধ মাত্রা জুড়ে ‘আইপি’ রঞ্জিত গুপ্ত নামের চরিত্রটি আপাদমস্তক বর্ণময়। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ পুলিশের উপরমহলের দায়িত্বে থাকতেন ‘ইম্পিরিয়াল পুলিশ’ (আইপি) স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অফিসারেরা। ১৯৪৮-এ চালু হয় ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস)। রঞ্জিতবাবু ছিলেন আইপি। তাঁর মৃত্যুর পরে দেশে এখন আইপি রইলেন মাত্র এক জন তামিলনাডুর শঙ্কর নারায়ণন। যিনি কেন্দ্রীয় এক গোয়েন্দা সংস্থার অধিকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছেন।
রঞ্জিতবাবুর বাবা নির্মলচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন ঢাকার অধ্যাপক। রঞ্জিতবাবুর জন্ম সেখানেই। পরে তিনি কলকাতায় আসেন, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করেন কৃতিত্বের সঙ্গে। ১৯৪২-এ যোগ দেন আইপি হিসেবে। দেশ ভাগের পরে, ১৯৪৮-এ হন কলকাতা পুলিশের ডিসি (সাউথ)। কিছু দিনের মধ্যে রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরণশঙ্কর রায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জ্যোতি বসুকে গ্রেফতারে উদ্যোগী হন। কিন্তু জ্যোতিবাবু পালিয়ে যান। কিরণবাবুর সন্দেহ হয়, রঞ্জিতবাবুই জ্যোতিবাবুকে পালাতে সাহায্য করেছেন। পুলিশের এক পদস্থ অফিসার জানাচ্ছেন, রঞ্জিতবাবু ছিলেন কিরণবাবুর আত্মীয়। এবং ক্রুদ্ধ কিরণবাবু রঞ্জিতবাবুর মা’কে ফোন করে বলেছিলেন, ‘নেহাত তোমার পোলা, নইলে আমি ওরে সাসপেন্ড করতাম!’
কংগ্রেস জমানার বিভিন্ন সময়ে বাম নেতাদের সঙ্গে গোপন যোগসাজসের অভিযোগ উঠেছিল রঞ্জিতবাবুর বিরুদ্ধে। বামপন্থী নেতা মোহিত সেন তাঁর ‘ট্রাভেলার্স অ্যান্ড দ্য রোড’ গ্রন্থে রঞ্জিতবাবুর সঙ্গে বাম-নেতৃত্বের ‘সখ্য’র কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। ’৬৯-এ জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে রঞ্জিতবাবুকে ডিআইজি (আইবি) নিযুক্ত করেন। ’৭০-এ পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনকালে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদপ্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করতে খোদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর পরামর্শ নিতে হয়েছিল। শেষমেশ রঞ্জিতবাবুই পদটি পান। আর ’৭২-এ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে একদা সহপাঠী রঞ্জিত গুপ্তকে করেন রাজ্য পুলিশের প্রধান। কিন্তু ’৭৬-এ জটিল এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সিদ্ধার্থবাবুই ওঁকে সরিয়ে দেন। রঞ্জিত গুপ্তের পুলিশ-জীবনে কার্যত ওখানেই ইতি।
প্রায় ১৪ বছর আগে অবসর নেওয়া অমিয়বাবু বলেন, “১৯৬৪-তে পুলিশে ঢোকার সময়ে আমার ঘোড়ায় চড়ার পরীক্ষা নিয়েছিলেন রঞ্জিতবাবু। উনি তখন ডিআইজি। সহকর্মীদের প্রত্যেককে যথোচিত মর্যাদা দিতেন।” আর এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “ইতিহাস, বিজ্ঞান, পুরাতত্ত্ব বিভিন্ন বিষয়ে ওঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। অনেক কিছু মনে রাখতেন, একাধিক বইও লিখেছেন।”
১৯৯২-এ রঞ্জিতবাবু কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ’৯৬-এ বসে পেসমেকার। কিন্তু জ্ঞানান্বেষণে
ভাটা পড়েনি। |